আম্মুলি,
অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। প্রায় চার মাস হয়ে গেলো তুমি চলে গেছো। অনেক কিছু হয়ে গেলো এই চার মাসে। লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে ওঠেনি। লিখতে পারিনি। লিখতে গেলেই বুক ভারি হয়ে আসতো, গলায় কি যেন আটকে যেতো আর নিজের অজান্তেই টপ টপ করে চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করতো।
তুমি চলে যাওয়ার দশ দিনের মাথায় আমি চাকরি পেলাম। যখন আমাকে জানানো হলো আমার চাকরি হয়ে গেছে, তখন আমি আনন্দে দুই লাফ দিয়ে মোবাইলে তোমার নম্বরটা বের করে ডায়াল করলাম খুশির খবরটা দেওয়ার জন্য। আর তক্ষুনি প্রথম বারের মতো বুঝতে পারলাম যে তুমি নাই। আমি সারা জীবন ফোন করে গেলেও কেউ ফোন ধরবে না। আমি আর কখনো তোমার বাচ্চাদের মতো গলার স্বরটা শুনতে পাবো না। আমার জীবনের কোনো বড় ঘটনার কথা আর কখনো বলতে পারবো না। আমার যেই ছেলেটার সাথে বিয়ে হবে, তাকে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। যদি কখনো বাচ্চা হয়, তার দেখা-শোনার দায়িত্ব তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবো না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না চেপে গেছিলাম।
তুমি চলে যাওয়ার পর জীবনে প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, একটা দাগ টেনে সব মানুষকে দাগের হয় এই পাশে অথবা ঐ পাশে ফেলে দেওয়া যায়। দাগের এই পাশের মানুষগুলো চরম দুঃসময়ে আমার পাশে থাকবে আর অন্যরা আমার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমার খুব কাছের কিছু মানুষ দাগের অন্য পাশে পড়লো। আর আমি কস্মিনকালেও যাদের কাছ থেকে কিছু আশা করিনি, তাদের অনেকেই পড়লো এই পাশে। আমি এখন কিছুটা হলেও মানুষ চিনতে শিখেছি।
ঐ দিন টিটুল বলছিলো ঢাকা মেডিকেলে তোমার কঙ্কালটা বেঁধে ফেলা হয়েছে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে নাকি। আমার ইচ্ছা করছিলো টিটুলকে বলি, “আমাকে মা’র কাছে নিয়ে যাও, মাকে দেখবো”। কিন্তু ভয় হলো। যদি তোমার কঙ্কাল দেখার পর আর কখনো তোমার সুন্দর মুখটা মনে না করতে পারি! অথবা যদি একবার দেখে ফেলার পর প্রত্যেক দিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তোমার কঙ্কালের সাথে গল্প করতে ইচ্ছা হয়!
‘ক্রাইম বিট’-এ ঢোকার পর আমি কতোটা শক্ত তা যাচাই করার জন্য প্রথম দিনই আমাকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে গেছিলো সুফিয়ান ভাই আর শাকিল। তোমাকে যেখানে শেষবার দেখেছিলাম, তার সামনে দিয়েই মর্গে যেতে হলো। চোখ ফেটে পানি আসছিলো। কিন্তু এইবারও কাঁদতে পারলাম না। যদি সুফিয়ান ভাইরা মনে করে আমি ‘ক্রাইম বিট’-এ কাজ করার মতো যথেষ্ট শক্ত মেয়ে না!
কাঁদাটা খুব জরুরি ছিল। ভেতরে অনেক বেশি দুঃখ জমে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে একদিন সৌমিক ‘স্কাইপ’-এ নক করলো। আমি ইচ্ছা করেই ভিডিও চালু না করে কথা বলতে থাকলাম। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বহু প্রতিক্ষিত কান্না শুরু হলো। প্রলাপ বকার মতো করে বলতে থাকলাম, “আমাকে আর কেউ কখনো ‘বাবুলি’ বলে ডাকবে নারে... কেউ কখনো আল্লাদি করে কথা বলবে না। কেউ অসময়ে ফোন করে বলবে না ‘আম্মুলি ভাত খেয়েছিস?’...” কাঁদতে কাঁদতেই ঠিক করলাম আর কখনো কাঁদবো না, মন খারাপ করে বসে থাকবো না। যা ভালো লাগে তাই করব। আর আমাকে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে যাতে মন খারাপ করার সময় না পাই। তা-ই করলাম। আমি এখন অনেক ব্যস্ত মা। নাচ শিখছি, চাকরি করছি, পড়াশোনা করছি, গল্প লিখছি..।
আমি সারা জীবন নিজের অজান্তেই তোমার মতো হওয়ার চেষ্টা করে গেছি। এখন তোমার কথা ভাবলে মনে হয় আমি যেন নিজের কথাই ভাবছি। আমি যেন তোমার প্রতিবিম্ব। তোমার মতোই ডানপিটে, রাস্তাঘাটে মারপিট করে বেড়াই। তোমার মতো কাজ পাগলা হয়ে যাচ্ছি। তোমার মতো করেই সব সময় অকপটে সত্যি কথা বলা শিখেছি। বাইরে ভীষণ শক্ত অথচ ভেতরটা গলা মাখনের মতো নরম। তোমার মতো মিষ্টি করে হাসতে পারি। শুধু একটা জিনিষ তোমার মতো না। আমি তোমার মতো নিঃস্বার্থ না। খুবই স্বার্থপর হয়েছি। সব সময় শুধু নিজের কথাই ভাবি। এই জন্যইতো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে বলে সমুদ্র সমান অভিমান নিয়ে বসে আছি। মানতেই পারছি না যে ঐ সময় চলে গিয়ে তুমি বেঁচে গেছো, শুধুমাত্র একদিন কষ্ট হয়েছিলো তোমার।
আমি ভালো আছি মা। আমার শুধু একটাই দুঃখ, কখনো বলা হলো না আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি।