১৩ই সেপ্টেম্বর, সকাল ৬:৩০
লুবনার ঘুম ভাঙল স্বামীর গালাগালিতে। প্রতিটা দিন গালিগালাজ শুনে ঘুম থেকে উঠতে ভাল লাগে না। গত বছরই বিয়ে হল। বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলেটাকেই বিয়ে করতে হয়েছিল লুবনার। যেই ছেলেটার সাথে সম্পর্ক ছিল, তাকে ছেড়ে এসেছিল বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। বিয়ের পর প্রথম এক সপ্তাহ কেটেছিল খুব আনন্দে। মনে হয়েছিল বাবা-মার কথায় বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা বিচক্ষণ ছিল। প্রথম সপ্তাহের আনন্দে গা ভাসিয়ে লুবনা তার স্বামীকে সব কথাই বলেছিল বিশ্বাস করে। স্বামী খুব মন দিয়ে শুনেছিল লুবনার প্রথম প্রেমের গল্প। ঠিক ৮ দিনের মাথায় শুরু হয় ঝামেলা। ওই দিন প্রথমবারের মত কুৎসিত ভাষায় গালি দেয় তার স্বামী। গালি দেওয়ার কারন, লুবনা নাকি নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়ে। আগের প্রেমিকের সাথে নাকি এখনো তার শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। লুবনা আকাশ থেকে পড়েছিল। কান্নাকাটি করে ভাসিয়েছিল। অনেক অভিমান হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে তার স্বামীকে বোঝাতে পেরেছিল, অতীত ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করেছে সে এবং এখন শুধু তাকেই ভালবাসে। স্বামীও মনে হয় বুঝতে পেরেছিল। কারন এরপর থেকে আবার শুরু হয় তাদের সুখের জীবন। বেশ ক’মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর লুবনা অনুভব করে তার শরীরে নতুন একটা প্রাণের অস্তিত্ব। আনন্দ আর উত্তেজনায় রাতে ঘুম হয় না তার। ঠিক করে, পর দিন রাতে স্বামীর জন্য বিশাল আয়োজন করে রান্নাবান্না করবে। খাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগে খুশির খবরটা দেবে স্বামীকে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিন্তু খবরটা শুনে লুবনার স্বামী ঠিক যেন খুশি হল না। একটা কথাও না বলে গম্ভীর মুখে ঘুমাতে গেল। পরদিন সকাল থেকেই শুরু হল আবার গালিগালাজ। অবলিলায় ভয়ঙ্কর সব কথা বলে যেতে থাকল লুবনার স্বামী। এবার অবশ্য আর থামেনি অকথ্য ভাষার গালি। রুটিন করে সকালে ঘুম থেকে উঠে এক ঘন্টা গালি, আবার রাতে বাসায় ফিরে এক ঘন্টা গালি। স্বামীর বদ্ধমূল ধারনা, লুবনার গর্ভে এসেছে তার আগের প্রেমিকের সন্তান। লুবনা প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা করেছে। মাসের পর মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও স্বামীকে বোঝাতে পারে না যে এটা তারই সন্তান। আগে দুঃস্বপ্নের মত মনে হলেও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটাই। কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না। কেমন যেন আচ্ছন্নের মত জীবন কাটাচ্ছে লুবনা। প্রতিদিন একরকম অপেক্ষাই করতে থাকে গালিগালাজের জন্য। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর পাঁচটা মাস পার হয়ে গেছে। আর ক’মাস পরই এই পৃথিবীর মুখ দেখবে নতুন একটা প্রাণ।
আজ সকাল থেকেই যেন মন কেমন করছে। অন্য দিনের মত স্বামী কাজে বের হয়ে যাওয়ার পর লুবনা একটা কাল সূতির শাড়ী পরে খুব সুন্দর করে সেজে বাসা থেকে বের হয়...
১৩ই সেপ্টেম্বর, দুপুর ১২:০০
ফারহানার বুক ধড়ফড় করছে। প্রেগনেন্সি টেস্টের স্ট্রিপটা চোখের সামনে ধরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে সে। ধীরে ধীরে ভেসে উঠল লাল রঙের ছোট্ট দু’টা দাগ। চোখের সামনে যেন তার পৃথিবীটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। মাত্র ১৭বছর বয়স তার। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। এখন তার সবটুকু মনযোগ থাকা উচিত পড়াশোনার দিকে। কিন্তু কিভাবে সে পড়তে বসবে? বয়ফ্রেন্ডের সহজ সরল অনুরোধ ফেলতে না পেরে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিটা নিয়ে নেয় সে। তখন নতুন ধরনের উত্তেজনায় এত কিছু মাথায় আসেনি। এর ক’দিনের মধ্যেই বয়ফ্রেন্ড আরেকটা মেয়ের জন্য নির্বিকার ভাবে তাকে ছেড়ে চলে যায়। ফারহানা বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এতোই ব্যাস্ত ছিল যে ধীরে ধীরে তার দূরত্ব বেড়ে যায় অন্য বন্ধুদের সাথে। এখন মনখুলে কথা বলার বা পরামর্শ করার মত মানুষও নেই তার জীবনে।
প্রেগনেন্সি টেস্টের স্ট্রিপটা এক হাতে ধরে রেখে অন্য হাতে মোবাইল ফোনটা নিয়ে ফারহানা কল করে সেই বয়ফ্রেন্ডের নম্বরে। ফোন ধরে সেই মেয়েটি, যার জন্য বয়ফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে চলে গেছিল। ফোন ধরেই বলল, ‘হ্যালো ফারহানা, তুমি এখনো কেন ওকে যন্ত্রণা করছ? কেন বুঝতে পারছ না ও এখন আমার সাথে আছে? প্লিজ তুমি আর কখনো এই নম্বরে ফোন করবে না’। ফারহানাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল মেয়েটি। ফারহানার শরীর কাঁপতে থাকে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে নোনা পানি।
কয়েক ঘন্টা পর কিছুটা ধাতস্ত হয়ে সে প্রথমেই ফোন করে তার এক বড়লোক সহপাঠীকে। ফারহানার এখন বেশ কিছু টাকা দরকার। সহপাঠী তাকে টাকা দিতে পারবে শুনে একটুও দেরি না করে বাসায় যেই শর্টস আর টি-শার্ট পরে ছিল, সেটা পরেই বের হয়ে পড়ল সে...
১৩ই সেপ্টেম্বর, দুপুর ১:৪৭
অফিসের লাঞ্চব্রেকে ছুটতে ছুটতে ছোট ছেলে আর মেয়েকে ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আর বড় ছেলেকে স্কুল থেকে তুলে বাসায় ফিরল ঝর্ণা। ফিরেই ফ্রিজ থেকে ৩ দিন আগে রান্না করে রাখা খাবার বের করে গরম করতে শুরু করে সে। কোন রকমে বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে আবার দৌড়াতে হবে অফিসে। তিন মাস হল তার শরীরের মধ্যে বড় হচ্ছে তাদের চার নম্বর বাচ্চাটা। এত ধকল আর সহ্য হয় না। সহজ সরল ভাল মানুষ বরটা আবারো তার চাকরি হারিয়েছে অফিসে মদ খেয়ে মাতলামি করার কারনে। আজ বাচ্চাদের তুলে বাড়ি ফেরার কথা ছিল বরেরই। কিন্তু ১২টার দিকে ফোন করে সে জানিয়েছে তার শরীর খারাপ তাই ঝর্ণাকেই যেতে হবে বাচ্চাদের আনতে। খাবার গরম করে বেড রুমে ঢুকে সে দেখল, যা ভেবেছে তা-ই। বরটা আয়েশ করে বিছানায় বসে মদ খাচ্ছে। দেখামাত্র মাথায় রক্ত চড়ে গেল ঝর্ণার।
সে তো কখনোই এরকম জীবন চায়নি। বাবা-মায়ের আদরের ছোট মেয়ে। সারা জীবন পড়াশোনায় ভাল ছিল। একটা এনজিওতে ঈর্ষণীয় বেতনের চাকরি করে। তার জীবনটা হওয়ার কথা রূপকথার রাজকন্যাদের মত আরামের, আনন্দের। দেশে দেশে ঘুরে ছুটি কাটিয়ে বেড়ানোর কথা তার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে’ বেঁচে থাকার কথা না।
হঠাৎই বাচ্চাগুলোর ওপর প্রচণ্ড রাগ হল ঝর্ণার। বাচ্চাগুলোই যত নষ্টের মূল। ওরা না থাকলে সে কত আরাম করেই না থাকতে পারত! কত নির্ঝঞ্ঝাট হত জীবন। এখন সংসারে যোগ হতে যাচ্ছে আরেকটি নতুন মুখ।
বরের হাত থেকে মদের গ্লাসটা নিয়ে দেওয়ালে ছুঁড়ে মেরে বাসা থেকে বের হয়ে যায় ঝর্ণা। মাইক্রোওয়েইভ ওভেনেই পড়ে থাকে গরম করা খাবারগুলো। বের হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আজ আর সে অফিসে ফিরবে না...
১৩ই সেপ্টেম্বর, বিকাল ৫:৫৫
দাঁতে দাঁত চেপে মানুষরূপী দানবটার মার সহ্য করছে অন্তরা। অসুরের মত শক্তি লোকটার গায়ে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। সহ্য করতে হবে যতক্ষণ জ্ঞান থাকে। কিল-ঘুষি-চড় শেষ হয়েছে। এখন চলছে লাথি। এইতো, আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে হবে না। মার খেতে খেতে অচেতন হয়ে পড়ে সে।
যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন পুরো বাড়ি অন্ধকার। লোকটা বাসায় নেই। ফুলে ওঠা মারের দাগগুলো দেখতে দেখতে সে ভাবা শুরু করে। ভেবে ভেবে কূল পায় না। কি করে সে ওই লোকটাকে ভালবেসেছিল? বিয়ের আগে যখন তারা প্রেম করত তখনো এক-দু’বার গায়ে হাত তুলেছিল ওই জানোয়ারটা। তখন অন্তরা ভেবেছিল, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। ভাবনাটা যে কতটা ভুল ছিল তা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। বিয়ের পর যেন দ্বিগুণ উৎসাহে নিজের সম্পত্তি মনে করে দানবটা তাকে পেটানো শুরু করল। তখন অন্তরা নিজেকে বুঝিয়েছে, আর মাত্র ক’টা দিন, তারপর একটা ফুটফুটে বাবু ঘরে এলেই লোকটা বদলে যাবে। এখন সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই সাত মাসে বদলায়নি কিছুই।
আহত শরীরটাকে টেনে টেনে সে কোন রকমে একটা কাপড় পরে নেয়। তারপর আলমারি থেকে কিছু টাকা বের করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়...
১৪ই সেপ্টেম্বর, সকাল ৮:১৫
সকালে সিটি কর্পোরেশনের নীল ট্রাকটা এসে থামে যাত্রাবাড়ির এক ডাস্টবিনের সামনে। ট্রাক থেকে ঝটপট তিনজন লোক নেমে ডাস্টবিনের ময়লাগুলো ট্রাকে তুলতে থাকে। ময়লা তুলতে তুলতে হঠাৎ অন্য রকম একটা বস্তা দেখতে পায় গিয়াস। কৌতুহলী হয়ে বস্তা খুলে সে যা দেখে, তাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ভক করে নাকে এসে লাগে সেই পরিচিত গন্ধটা। এই গন্ধ আগে সে একবারই পেয়েছে। রোড-অ্যাক্সিডেন্টে তার মা মারা যাওয়ার পর ২ দিন সেই লাশ পড়ে ছিল মর্গে। দু’দিন পর গিয়াস মর্গে গিয়ে লাশ দাবি করে। সেখানেই সে পেয়েছিল এই গন্ধ। নাড়ী উল্টে বমি আসার কথা। কিন্তু গিয়াসের বমি আসছে না। হতবিহবলের মত চারটা ছোট্ট ছোট্ট মৃত ভ্রুণের দিকে তাকিয়ে থেকে সে ভাবে, ‘এত সহজ?... এত সহজ?..... এতই সহজ জীবনের সবচেয়ে খাঁটি, সত্য আর নিষ্পাপ সম্পর্কটা শেষ করে ফেলা?’