তখন আমি পুনার ফার্গুসন কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক করছি। বাবা-মা ক’দিন ধরে ফোন করছে না বলে মন বেশ খারাপ। হঠাৎ এক রাতে একটা অপরিচিত মুম্বাই-এর নম্বর থেকে ফোন আসলো। ধরে দেখি ওদিক থেকে বাবা কথা বলছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এক কথা দু’কথায় বের হয়ে আসল যে বাবা-মা কোন এক জরুরী কাজে মুম্বাই এসেছে কয়েক দিনের জন্য। আমি তখন ভাবলাম, আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে ওরা। আনন্দে বাক-বাকুম করতে করতে তখনি মুম্বাই যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। রাত এগারোটায় পৌঁছালাম বাস্ স্টপে। মুম্বাই পৌঁছে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, ওরা আমাকে সারপ্রাইজ দিতে আসেনি। এসেছে, কারণ মা’র ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
কিন্তু এই গল্পটা মা’র ক্যান্সার নিয়ে না। এই গল্পটা একটা মেয়েকে নিয়ে, যে, পুনা থেকে মুম্বাই যাওয়ার সময় বাসে আমার পাশের সিটে বসেছিলো ।
বাস্ ছাড়লো সাড়ে এগারোটায়। ছেড়ে দেবার ঠিক এক মিনিট আগে একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাসে উঠলো এবং আমার পাশের সিটেই বসলো। আমি একটু বিরক্তই হলাম। ভেবেছিলাম আরাম করে দুইটা সিট দখল করে ঘুমাতে ঘুমাতে যাব। মেয়েটা ফর্সা, গালে অনেক ব্রণ, কোঁকড়া লম্বা চুল উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, চোখে চশমা। চেহারায় একটা বিব্রত ভাব। বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। আমি কনো কথা না বলে আইপডটা বের করে গান শোনা শুরু করলাম।
সেটাই ছিল আমার প্রথম বারের মতো বাসে করে মুম্বাই যাওয়া। আমি জানতাম পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যেটা জানতাম না সেটা হলো, পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পেরোতে গেলে কি পরিমান শরীর খারাপ হতে পারে। যখন বাস্ লোনাভ্লার কাছাকাছি পৌঁছালো, তখন থেকেই আমার শরীর গুলাতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি ড্রাইভারের কাছ থেকে পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে আসলাম। আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই শুরু হলো আমার বমি। বমির সাথে যোগ হলো মাথা ব্যাথা। সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে করতে একবার আড় চোখে পাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটার কিছুই হয়নি। দিব্যি নির্বিকার ভাবে জেফরি আর্চারের বই পড়ছে। বুঝলাম, তার মুম্বাই-পুনা যাতায়াত করে অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো মুম্বাই পৌঁছানোর পর। তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা। ল্যাম্প পোস্টের বিদঘুটে হলুদ আলোতে রাস্তা আলোকিত। বাস্ থেকে নেমে দেখি রাস্তা জন-মানবশূণ্য। শুধু কাছের একটা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে কয়েক জন ট্যাক্সি ড্রাইভার বসে বসে মদ খাচ্ছে। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েই পাঁই করে বাসটা চলে গেলো। সবাইকে নিতে কেউ না কেউ এসেছিল। সব শেষে দেখলাম পাশের সিটের মেয়েটাকেও নিতে আসলো একটা ছেলে। খুব সম্ভবত ওর বন্ধু। মেয়েটা গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর চলে গেল। আমি একা একা দাঁড়িয়ে থাকলাম কোন অটো-রিক্সা পাবার আশায়। একটু পরে খেয়াল করলাম, ঐ মাতাল ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে আর হাসছে। ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। তখন দেখি ড্রাইভারগুলো হেলতে-দুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অকথ্য সব কথা বলছে। মুখে নোংরা ধরণের হাসি। তাদের হলুদ দাঁতগুলো সোডিয়াম ল্যাম্পের আলোতে আরো হলুদ দেখাচ্ছিলো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। পকেট থেকে কলমটা বের করে শক্ত হাতে ধরলাম যাতে ওরা কাছে আসার চেষ্টা করলেই চোখে কলম ঢুকিয়ে দিতে পারি। এমন সময় কোথা থেকে যেন সাঁই করে একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। গাড়ির পেছনে একটা অটো-রিক্সা। গাড়ির ভেতরে বসে আছে বাসের ঐ মেয়েটা। আমাকে বললো, ‘তুমি চাইলে আমাদের গাড়িতে উঠতে পারো। আমরা তোমাকে পৌঁছে দেব। আমি কোনমতে বললাম, ‘না, লাগবে না’। তখন সে বললো, ‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। তাই তোমার জন্য অটো-রিক্সা ডেকে এনেছি। ভয় পেয়ো না। উঠে পড়ো। আমরা গাড়ি নিয়ে তোমার পিছে-পিছে আসছি। অটোওয়ালা তোমাকে কিছু করার সাহস পাবে না’।
আমি হতভম্ব অবস্থায় অটো-রিক্সায় উঠলাম। অটোওয়ালাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দেবার পর বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখছিলাম গাড়িটা আসছে কিনা। এর মধ্যে বাবাকে ফোন করে বললাম রাস্তায় এসে দাঁড়াতে।
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর, অটো-রিক্সা থেকে নেমে দৌড়ে গাড়িটার কাছে গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটা উত্তর দিলো, ‘শ্রুতি’। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে শুরু করলো। আমি তখন গিয়ে বাবার হাত ধরলাম। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম গাড়িটার দিকে।
শ্রুতির সাথে আমি আমার জীবনের চারটা ঘণ্টা কাটিয়েছি। সেদিন সে না থাকলে যে কি ভয়াবহ বিপদে পড়তাম, তা ভেবে আমি এখনো মাঝে মাঝে শিউরে উঠি। কিন্তু আমি চাইলেও কখনো এই পৃথিবীর ছয় বিলিয়ন মানু্ষের মাঝে আর তাকে খুঁজে বের করতে পারবো না।
শ্রুতির সাথে আমার সম্পর্কটা একটা হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক।