Sunday, November 27, 2011

পর্দার আড়ালে: 'ওয়ান্স'


ইচ্ছা থাকলে উপায় আসলেই হয়। এক চিমটি লবণের সমান বাজেট নিয়েও যে হাত বাড়ানো যায় অস্কারের দিকে, তা প্রমাণ করে দেয় ‘ওয়ান্স’ নামের সিনেমাটি। ডাবলিনের পটভূমিতে বানানো মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘ওয়ান্স’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। অদ্ভুত মিষ্টি বাস্তবধর্মী এই ছবিটি বানানোর জন্য পরিচালক জন কার্নির ভাগ্যে জুটেছিল বেশ কিছু পয়সাওয়ালা প্রযোজক। কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল নামকরা অভিনেতা ‘সিলিয়ান মার্ফি’র। কিন্তু মাঝ পথে প্রযোজকরা ভেটো দিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই সিনেমার কাহিনী কোনমতেই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারবে না। আর তখন নামকরা অভিনেতারাও আর রাজি হলেন না অভিনয় করতে। 
কিন্তু পরিচালকের পূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর নিজের কাজের ওপর। তিনি হাল ছাড়লেন না। শেষমেষ নবিন প্রযোজকদের সাহায্যে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে, হাতেগোনা ক’জন কর্মীর সাহায্যে ১৭দিন কাজ করে বানালেন সিনেমাটি। এবং তা দুনিয়াজুড়ে আয় করলো প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার। এবং পকেটে পুরলো বেশ কিছু ভারি অ্যাওয়ার্ড।
এই ছবির গানগুলো গেয়েছেন এবং কম্পোজ করেছেন কার্নির বন্ধু গ্লেন হ্যানসার্ড আর মার্কেটা ইর্গ্লোভা। পরিচালক যখন দেখলেন এত কম বাজেটে অভিনেতাদের ধরে রাখা যাচ্ছে না, তখন তিনি খুব সাহসী একটা কাজ করে ফেললেন। গ্লেন আর মার্কেটাকেই বললেন এই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য।
আর বন্ধুর অনুরোধে ঢেঁকিও গিললেন গ্লেন আর মার্কেটা। কিন্তু এতে সাপে বর হলো। তাঁদের আর আলাদা করে গান গাওয়ার অভিনয় করতে হলো না। খুবই সাবলীল হলো তাঁদের অংশগ্রহণ। দর্শক মাতালেন এবং কাঁদালেন তাঁদের সতঃস্ফূর্ততা দিয়ে।
পয়সা বাঁচানোর জন্য কার্নি শ্যুট করলেন দিনের আলো ব্যবহার করে আর সেট ছিল তাঁর বন্ধুদের বাড়ি। ডাব্লিনের রাস্তার দৃশ্যগুলো শ্যুট করা হলো পারমিট ছাড়াই, ‘লং লেন্স’ ব্যবহার করে। এ কারণে অধিকাংশ পথচারীই বুঝতে পারেননি যে ওখানে সিনেমার শ্যুটিং চলছে। ফলে সিনেমাটি হলো আরো বাস্তব সম্মত। আর এতে করে সুবিধাই হলো অনভিজ্ঞ অভিনেতাদের। নাকের ডগায় ক্যামেরা না থাকায় স্বচ্ছন্দেই অভিনয় করলেন তাঁরা।
তাঁদের গাওয়া ‘ফলিং স্লোলি’ গানটি ২০০৮ সালে অস্কার পায় ‘বেস্ট অরিজিনাল সাউন্ড ট্র্যাক’ ক্যাটাগরিতে।
সিনেমার কাহিনীতে গ্লেন আর মার্কেটার এক জনকে আরেক জনের ছেড়ে চলে যেতে হলেও, বাস্তবে তাঁরা ঠিকই জুটি বেঁধেছিলেন।

Friday, September 2, 2011

A HAPPY BIRTHDAY NOTE

The best part of a birthday is the party and the friends as long as you have someone else to buy the cake for you and prepare the food and clean the house. And usually, that someone else is your mom. She is the most excited person on your birthday. She will get the best available cake if not order a special cake. She will take out the prettiest dishes for the incredibly tasty food that she cooks. She will keep coming to you every ten minutes, all day long just to kiss you or to see whether you need something or just look at you with a very warm smile. But you always get irritated by her weird behavior on this day. You don’t want her in your room on your birthday when your friends are there. You don’t want her to ask you a thousand times whether you need something.
But the fact is she is the reason for your existence. You are the one who should be doing all those things she does on your birthday. You are the one who should be really thankful and go see your mom every 10 minutes. And kiss her a thousand times for being there all through.
Now, the worst part of a birthday is, if people don’t care enough to come and meet you on this day. And the cherry on top will be the fact that you don’t have your mom around anymore. And there’s no one to buy a cake for you. You have to buy your own birthday cake. I mean seriously, how pathetic can that be! You don’t even know how to cook, so you will order food from outside. And you don’t know where your mom used to keep those pretty dishes to serve the food. 
And finally you will realize the one thing you need the most is the kiss from your mom.

Wednesday, August 24, 2011

সম্পর্ক-২


তখন আমি পুনার ফার্গুসন কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক করছি। বাবা-মা ক’দিন ধরে ফোন করছে না বলে মন বেশ খারাপ। হঠাৎ এক রাতে একটা অপরিচিত মুম্বাই-এর নম্বর থেকে ফোন আসলো। ধরে দেখি ওদিক থেকে বাবা কথা বলছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এক কথা দু’কথায় বের হয়ে আসল যে বাবা-মা কোন এক জরুরী কাজে মুম্বাই এসেছে কয়েক দিনের জন্য। আমি তখন ভাবলাম, আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে ওরা। আনন্দে বাক-বাকুম করতে করতে তখনি মুম্বাই যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। রাত এগারোটায় পৌঁছালাম বাস্ স্টপে। মুম্বাই পৌঁছে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, ওরা আমাকে সারপ্রাইজ দিতে আসেনি। এসেছে, কারণ মা’র ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
কিন্তু এই গল্পটা মা’র ক্যান্সার নিয়ে না। এই গল্পটা একটা মেয়েকে নিয়ে, যে, পুনা থেকে মুম্বাই যাওয়ার সময় বাসে আমার পাশের সিটে বসেছিলো ।
বাস্ ছাড়লো সাড়ে এগারোটায়। ছেড়ে দেবার ঠিক এক মিনিট আগে একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাসে উঠলো এবং আমার পাশের সিটেই বসলো। আমি একটু বিরক্তই হলাম। ভেবেছিলাম আরাম করে দুইটা সিট দখল করে ঘুমাতে ঘুমাতে যাব। মেয়েটা ফর্সা, গালে অনেক ব্রণ, কোঁকড়া লম্বা চুল উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, চোখে চশমা। চেহারায় একটা বিব্রত ভাব। বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। আমি কনো কথা না বলে আইপডটা বের করে গান শোনা শুরু করলাম।
সেটাই ছিল আমার প্রথম বারের মতো বাসে করে মুম্বাই যাওয়া। আমি জানতাম পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যেটা জানতাম না সেটা হলো, পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পেরোতে গেলে কি পরিমান শরীর খারাপ হতে পারে। যখন বাস্ লোনাভ্লার কাছাকাছি পৌঁছালো, তখন থেকেই আমার শরীর গুলাতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি ড্রাইভারের কাছ থেকে পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে আসলাম। আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই শুরু হলো আমার বমি। বমির সাথে যোগ হলো মাথা ব্যাথা। সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে করতে একবার আড় চোখে পাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটার কিছুই হয়নি। দিব্যি নির্বিকার ভাবে জেফরি আর্চারের বই পড়ছে। বুঝলাম, তার মুম্বাই-পুনা যাতায়াত করে অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো মুম্বাই পৌঁছানোর পর। তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা। ল্যাম্প পোস্টের বিদঘুটে হলুদ আলোতে রাস্তা আলোকিত। বাস্ থেকে নেমে দেখি রাস্তা জন-মানবশূণ্য। শুধু কাছের একটা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে কয়েক জন ট্যাক্সি ড্রাইভার বসে বসে মদ খাচ্ছে। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েই পাঁই করে বাসটা চলে গেলো। সবাইকে নিতে কেউ না কেউ এসেছিল। সব শেষে দেখলাম পাশের সিটের মেয়েটাকেও নিতে আসলো একটা ছেলে। খুব সম্ভবত ওর বন্ধু। মেয়েটা গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর চলে গেল। আমি একা একা দাঁড়িয়ে থাকলাম কোন অটো-রিক্সা পাবার আশায়। একটু পরে খেয়াল করলাম, ঐ মাতাল ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে আর হাসছে। ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। তখন দেখি ড্রাইভারগুলো হেলতে-দুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অকথ্য সব কথা বলছে। মুখে নোংরা ধরণের হাসি। তাদের হলুদ দাঁতগুলো সোডিয়াম ল্যাম্পের আলোতে আরো হলুদ দেখাচ্ছিলো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। পকেট থেকে কলমটা বের করে শক্ত হাতে ধরলাম যাতে ওরা কাছে আসার চেষ্টা করলেই চোখে কলম ঢুকিয়ে দিতে পারি। এমন সময় কোথা থেকে যেন সাঁই করে একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। গাড়ির পেছনে একটা অটো-রিক্সা। গাড়ির ভেতরে বসে আছে বাসের ঐ মেয়েটা। আমাকে বললো, ‘তুমি চাইলে আমাদের গাড়িতে উঠতে পারো। আমরা তোমাকে পৌঁছে দেব। আমি কোনমতে বললাম, ‘না, লাগবে না’। তখন সে বললো, ‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। তাই তোমার জন্য অটো-রিক্সা ডেকে এনেছি। ভয় পেয়ো না। উঠে পড়ো। আমরা গাড়ি নিয়ে তোমার পিছে-পিছে আসছি। অটোওয়ালা তোমাকে কিছু করার সাহস পাবে না’।
আমি হতভম্ব অবস্থায় অটো-রিক্সায় উঠলাম। অটোওয়ালাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দেবার পর বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখছিলাম গাড়িটা আসছে কিনা। এর মধ্যে বাবাকে ফোন করে বললাম রাস্তায় এসে দাঁড়াতে।
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর, অটো-রিক্সা থেকে নেমে দৌড়ে গাড়িটার কাছে গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটা উত্তর দিলো, ‘শ্রুতি’। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে শুরু করলো। আমি তখন গিয়ে বাবার হাত ধরলাম। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম গাড়িটার দিকে।
 শ্রুতির সাথে আমি আমার জীবনের চারটা ঘণ্টা কাটিয়েছি সেদিন সে না থাকলে যে কি ভয়াবহ বিপদে পড়তাম, তা ভেবে আমি এখনো মাঝে মাঝে শিউরে উঠি। কিন্তু আমি চাইলেও কখনো এই পৃথিবীর ছয় বিলিয়ন মানু্ষের মাঝে আর তাকে খুঁজে বের করতে পারবো না।
শ্রুতির সাথে আমার সম্পর্কটা একটা হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক।

Tuesday, August 9, 2011

সম্পর্ক-১

প্রত্যেক দিন অফিসে ঢুকেই দেখতাম বুড়ো লোকটা সবার আগে এসে বসে আছে। বয়স তার সত্তর ছুঁই ছুঁই। সারাক্ষণ মুখে একটা ভাল-মানুষী হাসি লেগেই আছে। মোটা ফ্রেমের চশমা আর ঢোলা-ঢালা জামা পরে আসত। কথা বলত খুব ধীরে আর ভাঙা ভাঙা গলায়। যখন হাঁটতো তখন মনে হতো এক্ষুনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। কতবার এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে একটু সাহায্য করার কথা ভেবেছি, কিন্তু সেই ভাবনা, ভাবনাই রয়ে গেছে। আমরা একই সাথে একই অফিসে কাজ করেছি প্রায় ছ’মাস। কিন্তু কখনো কথা বলা হয়ে ওঠে নি। দূর থেকে খালি দেখতাম যে ছেলে মানুষের মতো আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। কাজ শেষ হয়ে গেলে সব সময় যেচে অন্য কাজ চেয়ে নিতো। দিনের শেষে বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেক দিন তার নাতীর বয়সী ‘বস’-দের কাছে বলত, ‘ভাই, আমারতো কাজ শেষ হয়ে গেছে, আমি কি বাড়ি যেতে পারি?’ বসরা লজ্জা পেয়ে বলতো ‘আরে হারুন ভাই, আপনি আমাদের কেন জিজ্ঞেস করছেন? আপনার যখন ইচ্ছা আপনি চলে যাবেন’। কিন্তু এরকম বেশি দিন চলেনি। অফিসের কাঠামোতে বড় ধরণের পরিবর্তন আসলোপুরোনো হর্তা-কর্তারা চলে গিয়ে নতুনরা আসলো। এবং কিছু দিনের মধ্যেই আমরা জানতে পারলাম হারুন ভাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত করার কোনো কারণ দেখানো হয়নি। অথচ সে ছিল পুরো অফিসে সবচেয়ে কর্মনিষ্ঠ লোক। আমরা সময় পেলেই কাজে ফাঁকি দেই কিন্তু তাকে কখনো কাজে ফাঁকি দিতে অথবা দায়িত্বে অবহেলা করতে দেখিনি। এই লোকটার বরখাস্তের খবর পাওয়ার পর খুব খারাপ লাগলো। মনে হলো, কেন আগে কখনো কথা বলিনি বুড়োটার সাথে, এর পরেতো আর কখনো দেখাও হবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, সে চলে যাওয়ার আগে একবার কথা বলবো। একটু সময় লাগল ওকে খুঁজে বের করতে। গিয়ে বললাম, ‘হারুন ভাই, আপনার ফোন নম্বরটা দেন না’। তখন সে তার সেই নির্মল ছেলে মানুষী হাসি হেসে বললো, ‘এইটা আমার নম্বর। মা, দেখো তো এই বুড়োটাকে কোথাও কাজে লাগাতে পারো কিনা।’ আমার তখন চোখ ফেটে পানি আসলো। কিন্তু কোনো মতে নিজেকে সামলে বুড়োর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অরিনের কাছে গেলাম একটু স্বান্ত্বনা পাবার আশায়। গিয়ে দেখি অরিন পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে আর ওর চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমাদের পুরো কথোপকথন সে শুনেছে। তখন ওকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে ধরে থাকলাম আর আমার চোখ থেকেও দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
আমি জানি, এই লোকটার সাথে আমার আর কখনো দেখা অথবা কথা হবে না। কিন্তু তার সাথে আমি আমার জীবনের ছ’টা মাস কাটিয়েছি। এবং লোকটার জন্য দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছি নানার সাথে আমার যে রকম সম্পর্ক ছিল, সে রকম একটা সম্পর্ক হয়তো হারুন ভাই-এর সাথে হতে পারত। কিন্তু সেটা কখনো হবে না।
হারুন ভাই-এর সাথে আমার সম্পর্কটা একটা ফসকে যাওয়া সম্পর্ক।
(উৎসর্গ: হারুনর রশীদ)

Friday, June 3, 2011

মা


আম্মুলি,
        অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। প্রায় চার মাস হয়ে গেলো তুমি চলে গেছো। অনেক কিছু হয়ে গেলো এই চার মাসে। লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে ওঠেনি। লিখতে পারিনি। লিখতে গেলেই বুক ভারি হয়ে আসতো, গলায় কি যেন আটকে যেতো আর নিজের অজান্তেই টপ টপ করে চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করতো।
তুমি চলে যাওয়ার দশ দিনের মাথায় আমি চাকরি পেলাম। যখন আমাকে জানানো হলো আমার চাকরি হয়ে গেছে, তখন আমি আনন্দে দুই লাফ দিয়ে মোবাইলে তোমার নম্বরটা বের করে ডায়াল করলাম খুশির খবরটা দেওয়ার জন্য। আর তক্ষুনি প্রথম বারের মতো বুঝতে পারলাম যে তুমি নাই। আমি সারা জীবন ফোন করে গেলেও কেউ ফোন ধরবে না। আমি আর কখনো তোমার বাচ্চাদের মতো গলার স্বরটা শুনতে পাবো না। আমার জীবনের কোনো বড় ঘটনার কথা আর কখনো বলতে পারবো না। আমার যেই ছেলেটার সাথে বিয়ে হবে, তাকে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। যদি কখনো বাচ্চা হয়, তার দেখা-শোনার দায়িত্ব তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবো না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না চেপে গেছিলাম।
তুমি চলে যাওয়ার পর জীবনে প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, একটা দাগ টেনে সব মানুষকে দাগের হয় এই পাশে অথবা ঐ পাশে ফেলে দেওয়া যায়। দাগের এই পাশের মানুষগুলো চরম দুঃসময়ে আমার পাশে থাকবে আর অন্যরা আমার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমার খুব কাছের কিছু মানুষ দাগের অন্য পাশে পড়লো। আর আমি কস্মিনকালেও যাদের কাছ থেকে কিছু আশা করিনি, তাদের অনেকেই পড়লো এই পাশে। আমি এখন কিছুটা হলেও মানুষ চিনতে শিখেছি।
ঐ দিন টিটুল বলছিলো ঢাকা মেডিকেলে তোমার কঙ্কালটা বেঁধে ফেলা হয়েছে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে নাকি। আমার ইচ্ছা করছিলো টিটুলকে বলি, “আমাকে মা’র কাছে নিয়ে যাও, মাকে দেখবো”। কিন্তু ভয় হলো। যদি তোমার কঙ্কাল দেখার পর আর কখনো তোমার সুন্দর মুখটা মনে না করতে পারি! অথবা যদি একবার দেখে ফেলার পর প্রত্যেক দিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তোমার কঙ্কালের সাথে গল্প করতে ইচ্ছা হয়!
‘ক্রাইম বিট’-এ ঢোকার পর আমি কতোটা শক্ত তা যাচাই করার জন্য প্রথম দিনই আমাকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে গেছিলো সুফিয়ান ভাই আর শাকিল। তোমাকে যেখানে শেষবার দেখেছিলাম, তার সামনে দিয়েই মর্গে যেতে হলো। চোখ ফেটে পানি আসছিলো। কিন্তু এইবারও কাঁদতে পারলাম না। যদি সুফিয়ান ভাইরা মনে করে আমি ‘ক্রাইম বিট’-এ কাজ করার মতো যথেষ্ট শক্ত মেয়ে না!   
কাঁদাটা খুব জরুরি ছিল। ভেতরে অনেক বেশি দুঃখ জমে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে একদিন সৌমিক ‘স্কাইপ’-এ নক করলো। আমি ইচ্ছা করেই ভিডিও চালু না করে কথা বলতে থাকলাম। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বহু প্রতিক্ষিত কান্না শুরু হলো। প্রলাপ বকার মতো করে বলতে থাকলাম, “আমাকে আর কেউ কখনো ‘বাবুলি’ বলে ডাকবে নারে... কেউ কখনো আল্লাদি করে কথা বলবে না। কেউ অসময়ে ফোন করে বলবে না ‘আম্মুলি ভাত খেয়েছিস?’...” কাঁদতে কাঁদতেই ঠিক করলাম আর কখনো কাঁদবো না, মন খারাপ করে বসে থাকবো না। যা ভালো লাগে তাই করব। আর আমাকে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে যাতে মন খারাপ করার সময় না পাই। তা-ই করলাম। আমি এখন অনেক ব্যস্ত মা। নাচ শিখছি, চাকরি করছি, পড়াশোনা করছি, গল্প লিখছি..।
আমি সারা জীবন নিজের অজান্তেই তোমার মতো হওয়ার চেষ্টা করে গেছি। এখন তোমার কথা ভাবলে মনে হয় আমি যেন নিজের কথাই ভাবছি। আমি যেন তোমার প্রতিবিম্ব। তোমার মতোই ডানপিটে, রাস্তাঘাটে মারপিট করে বেড়াই। তোমার মতো কাজ পাগলা হয়ে যাচ্ছি। তোমার মতো করেই সব সময় অকপটে সত্যি কথা বলা শিখেছি। বাইরে ভীষণ শক্ত অথচ ভেতরটা গলা মাখনের মতো নরম। তোমার মতো মিষ্টি করে হাসতে পারি। শুধু একটা জিনিষ তোমার মতো না। আমি তোমার মতো নিঃস্বার্থ না। খুবই স্বার্থপর হয়েছি। সব সময় শুধু নিজের কথাই ভাবি। এই জন্যইতো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে বলে সমুদ্র সমান অভিমান নিয়ে বসে আছি। মানতেই পারছি না যে ঐ সময় চলে গিয়ে তুমি বেঁচে গেছো, শুধুমাত্র একদিন কষ্ট হয়েছিলো তোমার।       
আমি ভালো আছি মা। আমার শুধু একটাই দুঃখ, কখনো বলা হলো না আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি।
                                                                                  তোমার বাবুলি
     

Sunday, May 29, 2011

ঝিনুক

আমি যখন ক্লাস টু-তে উঠবো তখন বাবার বদলি হয়ে গেলো ‘ইওয়াকি’তে। আমার খুব খারাপ লাগছিলো স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে যেতে। নতুন জায়গার কথা ভেবে একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম।
‘ইওয়াকি’র ‘ফুজিমা’ স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। প্রথম দিন টিচার আসার আগেই ক্লাসে গিয়ে হাজির হলাম। ক্লাসের পেছনে কয়েকটা ছেলে জটলা পাকিয়ে কি নিয়ে যেন কথা বলছিলো। আমি যখন শেষ দিকের একটা চেয়ারে বসতে যাব, তখন কেউ একজন চেয়ারটা টান দিয়ে সরিয়ে নিল। আর আমি ধপ্পাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম, সাথে সাথে সবাই হা-হা করে হেসে উঠলো। রাগে, দুঃখে, লজ্জায় আমার চোখে পানি চলে আসছিলো। কিন্তু তখনি টিচার চলে আসলো বলে চোখের পানি সামলে কোনোমতে উঠে বসতে বসতে আড় চোখে দেখে নিলাম কে আমাকে ফেলে দিয়েছে।
ছেলেটার চোখ লম্বা চুলে ঢেকে ছিল। আর হাসিটা ছিল একান থেকে ওকান পর্যন্ত বিস্তৃত। দেখেই আমার গা জ্বলে গেলো। পরে জানতে পেরেছিলাম ওর নাম ‘হিরোতো’।
নতুন স্কুলে আমারতো কোনো বন্ধু হলোই না, উল্টো প্রত্যেক দিন হিরোতো আমাকে সবার সামনে বিভিন্ন ভাবে অপদস্থ করতে থাকলো। একদিন এসে আমার দিকে মুঠ করা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ‘নাও’। আমিও সরল মনে হাত পাতলাম। ও তখন আমার হাতে নরম নরম কিলবিলে একটা টিকটিকি ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আমি লাফিয়ে, চিৎকার করে, কেঁদেকেটে অস্থির। পরের দিন আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলো। সেটা তিন বার শ্যাম্পু করার পরেও উঠছিলো না বলে চুল ছোট করে কেটে ফেলতে হলো। আর খেলার ক্লাসে আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়াতো ছিল প্রতি দিনের ঘটনা।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে সব কিছু সহ্য করে শীতের ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ছুটি হলেই মা আমাকে নিয়ে ‘কাগোশিমা’ বেড়াতে যাবে।
ছুটির আগের দিন ক্লাসের পর আমি যখন ব্যাগে বই খাতা ঢোকাচ্ছিলাম, তখন হিরোতো এসে ঐ দিনের মতো মুঠ করা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ‘নাও’। আমি সতর্ক হয়ে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়ালাম। ও তখন আমার ডেস্কের উপর কি যেন একটা রেখে অনেক ক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে চলে গেলো। আমি এক পা এক পা করে ডেস্কের কাছে গিয়ে জিনিষটা কি বোঝার চেষ্টা করি। হাতে নিয়ে দেখলাম একটা টিস্যু পেপারে মোড়ানো দুইটা বড় বড় ঝিনুক। একটা গোলাপী আর অন্যটা আকাশী রং করা। টিস্যু পেপারটাতে লেখা ‘তুমি আর আমি’। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটা অদ্ভুত খুশীতে ভরে গেলো।
খুশী খশী মনে ৯/৩/২০১১-তে ‘কাগোশিমা’র উদ্দেশ্যে আমি রওনা দিলাম মা’র সাথে। পৌঁছে আমরা খালার বাসায় উঠলাম। প্রথম দিন বিশ্রাম নিয়ে কাটালাম।

এগারোই মার্চ ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আর সুনামি তছনছ করে দিলো জাপানের উত্তর-পূর্ব সমুদ্র উপকূল। প্রথম পাওয়া ৩৫০টা লাশের মধ্যে একটা ছিলো হিরোতোর লাশ।