প্রত্যেক দিন অফিসে ঢুকেই দেখতাম বুড়ো লোকটা সবার আগে এসে বসে আছে। বয়স তার সত্তর ছুঁই ছুঁই। সারাক্ষণ মুখে একটা ভাল-মানুষী হাসি লেগেই আছে। মোটা ফ্রেমের চশমা আর ঢোলা-ঢালা জামা পরে আসত। কথা বলত খুব ধীরে আর ভাঙা ভাঙা গলায়। যখন হাঁটতো তখন মনে হতো এক্ষুনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। কতবার এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে একটু সাহায্য করার কথা ভেবেছি, কিন্তু সেই ভাবনা, ভাবনাই রয়ে গেছে। আমরা একই সাথে একই অফিসে কাজ করেছি প্রায় ছ’মাস। কিন্তু কখনো কথা বলা হয়ে ওঠে নি। দূর থেকে খালি দেখতাম যে ছেলে মানুষের মতো আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। কাজ শেষ হয়ে গেলে সব সময় যেচে অন্য কাজ চেয়ে নিতো। দিনের শেষে বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেক দিন তার নাতীর বয়সী ‘বস’-দের কাছে বলত, ‘ভাই, আমারতো কাজ শেষ হয়ে গেছে, আমি কি বাড়ি যেতে পারি?’ বসরা লজ্জা পেয়ে বলতো ‘আরে হারুন ভাই, আপনি আমাদের কেন জিজ্ঞেস করছেন? আপনার যখন ইচ্ছা আপনি চলে যাবেন’। কিন্তু এরকম বেশি দিন চলেনি। অফিসের কাঠামোতে বড় ধরণের পরিবর্তন আসলো। পুরোনো হর্তা-কর্তারা চলে গিয়ে নতুনরা আসলো। এবং কিছু দিনের মধ্যেই আমরা জানতে পারলাম হারুন ভাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত করার কোনো কারণ দেখানো হয়নি। অথচ সে ছিল পুরো অফিসে সবচেয়ে কর্মনিষ্ঠ লোক। আমরা সময় পেলেই কাজে ফাঁকি দেই কিন্তু তাকে কখনো কাজে ফাঁকি দিতে অথবা দায়িত্বে অবহেলা করতে দেখিনি। এই লোকটার বরখাস্তের খবর পাওয়ার পর খুব খারাপ লাগলো। মনে হলো, কেন আগে কখনো কথা বলিনি বুড়োটার সাথে, এর পরেতো আর কখনো দেখাও হবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, সে চলে যাওয়ার আগে একবার কথা বলবো। একটু সময় লাগল ওকে খুঁজে বের করতে। গিয়ে বললাম, ‘হারুন ভাই, আপনার ফোন নম্বরটা দেন না’। তখন সে তার সেই নির্মল ছেলে মানুষী হাসি হেসে বললো, ‘এইটা আমার নম্বর। মা, দেখো তো এই বুড়োটাকে কোথাও কাজে লাগাতে পারো কিনা।’ আমার তখন চোখ ফেটে পানি আসলো। কিন্তু কোনো মতে নিজেকে সামলে বুড়োর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অরিনের কাছে গেলাম একটু স্বান্ত্বনা পাবার আশায়। গিয়ে দেখি অরিন পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে আর ওর চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমাদের পুরো কথোপকথন সে শুনেছে। তখন ওকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে ধরে থাকলাম আর আমার চোখ থেকেও দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
আমি জানি, এই লোকটার সাথে আমার আর কখনো দেখা অথবা কথা হবে না। কিন্তু তার সাথে আমি আমার জীবনের ছ’টা মাস কাটিয়েছি। এবং লোকটার জন্য দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছি। নানার সাথে আমার যে রকম সম্পর্ক ছিল, সে রকম একটা সম্পর্ক হয়তো হারুন ভাই-এর সাথে হতে পারত। কিন্তু সেটা কখনো হবে না।
হারুন ভাই-এর সাথে আমার সম্পর্কটা একটা ফসকে যাওয়া সম্পর্ক।
(উৎসর্গ: হারুনর রশীদ)
Awesome narrative. Feeling sad after read it. :(
ReplyDeleteread the next one n then feel sad ;)
ReplyDeleteThere's another one? part-2? Are you posting today?
ReplyDeletepart2 is coming, but not tonight. read the story next to this one. its called 'মা'...
ReplyDelete:o Really !!! ??? :-/ Aww Noo... Need to find out the reason for our mental satisfaction...
ReplyDeleteকেউ জানেনা একেকেটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়-
ReplyDeleteকোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, হায়, কেউ জানে না!
Twisha, I am amazed.
ReplyDeleteYou have expressed the feelings of most of us. I will call and let Harun Bhai read your Blog. at the earliest possible time this morning. Most of us do not know that you write so good and we can visualise while reading your story ......
thanks a lot bulbul bhai...
ReplyDeleteহারুন ভাই-এর সাথে আমার সম্পর্কটা একটা ফসকে যাওয়া সম্পর্ক।
ReplyDeleteOh My God. Twisha, sorry for misunderstanding your talent. I also miss Harun bhai, but it's impossible for me to express the emotion of missing someone in such a small but very power sentence. Great.
MISS YOU HARUN BHAI. HAD I THE ABILITY TO DO SOMETHING FOR YOU!
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete