Tuesday, December 31, 2013

Seize the Moment

It's life, it's your life;
Life is to live, you're alive.
Feel it, live it;
Breathe it, drink it.
Catch the sun, touch the stars;
Reach out for the Mars.
Love and let love,
Love yourself, love the wind;
Love the colour, love blind.
You're careless, you're carefree;
You're fearless, you live free.
Is it strange-
That you dare to change?
Possibilities await you-
Step out from the cage.
It's true, when you're blue;
Lights fade out and there's only you.
Don't shy away, don't hide behind;
Don't let people fold you blind.
It's fine to be diverse;
It's okay to be unlike;
It's alright to be unusual;
It's perfect to be special.
Seize the moment, capture the chance;
sing the lament, take the stance.
:)

Wednesday, June 12, 2013

সুখ



আমার কিসে সুখ?
দরজা বন্ধ করে একটু নাচতে পারলেই সুখ।
সাগর তটে পড়ে থাকা জ্যান্ত এক শামুক;
কাজ না করে বই পড়াতেই আমার যত সুখ।
যখন দেখি আমার মায়ের হাসি মাখা মুখ;
আর হঠাৎ হঠাৎ আমার বাবার গর্বে ভরা বুক।
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যাবেলা জ্বর আসলেও সুখ;
আর ভোরবেলা বারান্দাতে কফির এক চুমুক।
দিনের শেষে বাসায় ফিরে ল্যাপটপে ফেসবুক;
স্ট্যাটাসটা শেয়ার হলেই আমার যত সুখ।

Thursday, April 18, 2013

মুক্তিযুদ্ধ, ২০১৩

          ‘ম্যাজিক’ নামের টেম্পো জাতীয় একটি গাড়িতে করে প্রতিবাদী গান গাইতে গাইতে সুন্দরগঞ্জের আমাদী গ্রামের দিকে ছুটে চলেছে সুন্দর চেহারার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, অসম্ভব বুদ্ধিমান ওরা ৬ জন। দেখে মনে হচ্ছে ‘মুক্তির গান’ প্রমাণ্যচিত্র থেকে এই ৬ জনকে উঠিয়ে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালের গাইবান্ধায়। প্রচণ্ড বাতাসে উড়ছে সবার চুল আর কাপড়ের প্রান্ত। ‘দুর্গম গিরি’ শেষ করে ‘মুক্তির মন্দির’ ধরলো ওরা। একজন ননস্টপ ভিডিও করে চলেছে। প্রত্যেকেই নিজেকে অসাধারণ সৌভাগ্যবান মনে করছে। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কর্মীদের মতো এই রকম করে গান গেয়ে পুরো বাংলাদেশ ঘুরতে পারছে বলে গর্বে বুকটা ফুলে আছে ১০ হাত।
          হঠাৎ করেই গলায় গান আটকে গেল সবার। রাস্তার পাশে ব্রেক করে থেমেছে ‘ম্যাজিক’ এবং ওরা দেখতে পেয়েছে সুন্দরগঞ্জের প্রথম ধ্বংসস্তুপ। গণসার হাটের দোকানগুলো দুমড়ে-মুচড়ে ফেলা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দোকানেই ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন। বেশ কিছু দোকান কাত হয়ে আছে একদিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওরা আগেই নিজেদের মধ্যে ঠিক করে রেখেছিল কে কোন দায়িত্ব পালন করবে। দুইজন থাকবে ঢাকা থেকে সংগ্রহ করে বয়ে আনা অর্থের দায়িত্বে। একজনের কাজ হবে ছবি তোলা, আরেকজন করবে ভিডিও। ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে সব তথ্য লিপিবদ্ধ করবে একজন। এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবে একজন। কিন্তু কিসের কি! ‘ম্যাজিক’ থেকে নেমেই যে যার মতো করে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করা শুরু করলো। সবার হাতেই মোবাইল, ক্যামেরা, খাতা আর কলম। সবাই একসাথে তখনি জানতে চায় কিভাবে ওইদিন হামলা করেছিল জামাত-শিবির। ওই হাটেই ওরা দেখা পেলো শরীফুল ইসলামের পানের দোকানের। এই দোকান থেকেই শরীফুলকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় সামনের একটি ধানক্ষেতে। সেখানেই তাকে অঙ্গচ্ছেদ করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। শরীফুলের একমাত্র দোষ, সে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চেয়েছিল। পানের দোকানটি প্রথমে ভাংচুর করে পরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এই বিভৎস ঘটনা ওরা শুনলো শরীফুলের ভাই সাজু মিয়ার কাছ থেকে। শরীফুলকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন তিনি। ওরা দেখলো শরীফুলকে কিরকম নৃশংস উপায় খুন করা হয়েছে তা বলতে বলতে সাজু কেঁদে ফেলছে বারবার।
          গণসার হাট থেকে ওরা গেলো সুন্দরগঞ্জের অন্যান্য গ্রামেও। সেখানে ওরা দেখল মাইলের পর মাইল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাস্তার পাশের ঘরবাড়ি আর দোকানপাট উপজেলার কঞ্চিবাড়ি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা খাদেম হোসেন ও তার ছেলের ঘর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে মারধোর করেছে। দুই মেয়ের মধ্যে একজনের মাত্র তিন মাস আগে সিজারিয়ান হয়েছিল এবং তার সেলাইয়ের জায়গায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে জামাত-শিবির কর্মীরাজ্বালিয়ে দিয়েছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কাকলী বেগমের বাড়ি-ঘর। এর সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়েছে কুরআন শরীফ, হারমোনিয়াম এবং বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক। জামাত-শিবিরের হামলার হাত থেকে রক্ষা পায়নি ওই এলাকার জেলে পাড়াও। জেলে পাড়া পেরোলে চর এলাকার দেখা মেলে, যেখানে জমি চাষ করে ফসল ফলানো হয়। অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য। বাংলার অপরূপ চেহারা দেখে হঠাৎ কেমন যেন থতমত খেয়ে যায় ওরা ৬ জন। চুপচাপ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কেউ কেউ অন্যদের লুকিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।  ওরা কিছুতেই মেলাতে পারে না, এই অদ্ভুত সুন্দর বাংলাদেশকে কি করে জামাত-শিবির নিজ হাতে নিঃশেষ করে ফেলছে! এর কয়েক কিলোমিটার পেছনেই কিভাবে নৃশংস ভাবে মানুষ খুন করা হচ্ছে! কিভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শান্তিপ্রিয় মাটির মানুষগুলোর ঘরবাড়ি! এলাকাবাসীদের কাছ থেকেই ওরা জানতে পারলো অনেক হামলাকরীই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা স্থানীয় প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 
          ২৮শে ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়টি ছিল শাহবাগে ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থান নেওয়া অসংখ্য তরুণ-তরুণীর অন্যতম বিজয়। রায়টি হওয়ার সাথে সাথে শাহবাগ থেকে বের হয় বিজয় মিছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে একে অপরের সাথে করমর্দন এবং কোলাকুলি করে সেখানে অবস্থানরত জনতা। তারা তখনো জানত না আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ পরিণত হবে এক রণক্ষেত্রে। পুড়িয়ে দেওয়া হবে বাড়িঘর-দোকানপাট, খুন করা হবে মানুষ, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে গ্রামের পর গ্রাম। ২৮শে ফেব্রুয়ারি সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামাত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমেছে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য। এরকম কিছু একটা হতে পারে তা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু এর মাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারোই। সন্ধ্যা হতে না হতেই মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ত্রিশের ওপরে। রাত গড়িয়ে সকাল হতে হতে সেই সংখ্যা অতিক্রম করলো একশ জামাত-শিবিরের ধরিয়ে দেয়া আগুনে জ্বলতে থাকে বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস-আদালত। কোন কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয় অমুসলিম জনগোষ্ঠী। ভেঙ্গে ফেলা হয় প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হয় মন্দির। পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের পরউপড়ে ফেলা হয় রেললাইন, পুড়িয়ে দেয়া হয় বাস-ট্রাক, ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকে যানবাহনের ওপর। ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ চালানো হয় থানা-পুলিশের ওপর। পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় তাদেরকে।
পহেলা মার্চ থেকে শুরু হয় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর লম্ফ-ঝম্প। এবং ৫ই মার্চ মুখ খোলেন বেগম জিয়া। সেই মুখ থেকে বের হয়ে আসা একটি শব্দে স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রগতিশীল তরুণ সমাজ। শব্দটি ছিল গণহত্যামানবাধিকার সংগঠনগুলোরও বক্তব্য মোটা দাগে একই- গণহত্যা চলছে বাংলাদেশে২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই তাণ্ডবের বর্ণনা ঢালাওভাবে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হতে থাকে। প্রশাসন, আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা-অসহায়ত্ব, ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা এবং নিরীহ মানুষের হাহাকার দেখে পুরো জাতি এক অসহায় ক্রোধে কাঁপতে থাকে।
          জামাত-শিবিরের সহিংসতা ভাবিয়ে তুলতে থাকে ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে থাকা শত শত তরুণ-তরুণীকেঅবস্থার উন্নতির কোন আলামত যখন দেখা গেলো না, তখন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে কিছু তরুণ-তরুণী ডুবে যেতে থাকে হতাশায়। বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুন ছাইচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। অনলাইন ঘেঁটে দেখে কোথাও এক চিলতে আশার আলো দেখা যায় কিনা। ওরা সবাই কিছু একটা করতে চায় এই নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্য। কিন্তু কিভাবে কি করবে কিছু বুঝে পাচ্ছে না। তখনো ওরা কেউই জানতো না এর ঠিক এক ঘন্টা আগে দক্ষিণ ঢাকার এক তরুণ ফেইসবুকে একটি ইভেন্ট খুলেছে। ইভেন্টটির নাম: সাপোর্টিং দ্য ভিক্টিমস অফ জামাত-শিবির অ্যাটাকসফেইসবুকের ওই ইভেন্টে যোগ দেয় অনেকেই। কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় হাতেগুনে ৬ জন। শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহল থেকে অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহের কাজ। গঠিত হয় একটি ছোট্ট রিসার্চ টিম। যারা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে এবং স্থানীয় লোকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একেকটি এলাকার ক্ষতির পরিমাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু তখনো আক্রান্ত এলাকাগুলো দুর্ভেদ্য। ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না কিভাবে ওই এলাকাগুলোতে যাবে কোন কূল কিনারা না পেয়ে তারা তাদের রিসার্চের আলোকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখলো, আক্রান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে নোয়াখালির বেগমগঞ্জে যাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু একই কারণে সেখানে ইতিমধ্যে অনেক সংগঠন থেকে সাহায্য করার জন্য মানুষ গেছে। এরকম সময় হঠাৎই একদিন তারা খবর পেলো মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের বাঁশখালী পরিদর্শনে যাবেন পরের দিনই। শোনা মাত্রই অসম্ভব মেধাবী, তারুণ্যে ভরপুর, জ্বলজ্বলে করিৎকর্মা এই ছোট্ট দলটা বুঝে গেল এই সুযোগকে কাজে লাগাতেই হবে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের জন্য ওই এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। সুতরাং তাদেরদের মিশে যেতে হবে ওই দলের সাথে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ! পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতের আঁধারে ওরা ৪ জন রওনা দিলো বাস ধরার উদ্দেশ্যে।
          চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানোর পর হঠাৎই ওদের মাথায় আসল এই ছোট্ট দলটার কোন পরিচয় নেই। ওরা নিজেদের জন্য কোন নাম ঠিক করেনি। শহর থেকে বাঁশখালী যাওয়ার পথে নিজেদের মধ্যে ছোট খাট তর্কও হয়ে যায় নাম নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, নাম হবে আমরাকারণ, ‘আমরাশব্দটি অনেক আপন। আমরা শব্দটি বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। এবং একের অধিক মানুষ যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়, তখনই সেটা আমরাহয়ে যায়। একতার ন্যূনতম একক আমরা ‘আমরা’ তারাই যারা পুরো দেশে নৈরাজ্য চালানো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বারবার। শুরুটা এভাবেই। রা মার্চ জন্ম নেয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'আমরা'
বাঁশখালীতে ওরা পৌঁছেছে ঘটনা ঘটার ৯ দিন পরে। কিন্তু তখনো দেখে মনে হচ্ছিল গতকালই হামলা করেছে জামাত-শিবির। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে শিল পাড়ার মানুষগুলো। বাঁশখালীর  দৃশ্যটি একই সাথে করুণ, হৃদয়বিদারী, হতাশাজনক এবং ভীতিকর। যে দিকেই চোখ যায় শুধু পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর, মানুষের কান্না আর হাহাকার। একটা চুলা ছাড়া কিছুই নেই ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পায় নি গৃহপালিত গরুগুলোও। বেঁচে গেছে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। সেই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে রাত কাটাচ্ছে জনা ত্রিশেক মানুষ। দিন কাটে খোলা আকাশের নিচে। ঘন্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামাত শিবির কর্মীরা। কিন্তু ওই এক ঘন্টাই যথেষ্ট ছিল শীলপাড়াকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার জন্য। এই দৃশ্য দেখে ওরা কেউ দমে গেল না। বরং রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় আরো দৃঢ়চেতা হয়ে উঠলো। ভেঙ্গে পড়ার বদলে ওরা সবাই আরো শক্ত, আরো উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠলোওরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিলো ওরা বুঝে গেল, অসহায় নিরিহ মানুষগুলোর পাশে শুধু মাত্র অর্থ সাহায্য নিয়ে দাঁড়ালেই হবে না। তাদেরকে নৈতিক সমর্থনও দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের জানতে হবে ওরা একা না, এই যুদ্ধে ‘আমরা’ তাদের পাশে আছেওদের বুঝতে হবে ওদের দুঃসময়ে, ওদের প্রয়োজনে ‘আমরা’ বারবার ছুটে আসবে বাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত থেকে।
অতর্কিত হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় সাধারণ মানুষ পুলিশকে পাশে পায়নি তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে নিজেরাই রুখে দাঁড়িয়েছেতাদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে জামায়াত-শিবিরের উন্মত্ত কর্মী-সমর্থকরাস্থানীয়দের কাছ থেকে এই বর্ণনা শুনে এক চিলতে আশার আলো দেখতে পেলো ‘আমরা’সাম্প্রদায়িক বর্বরতার চেয়ে সাধারণ মানুষের সম্প্রীতির শক্তিটা অনেক বড় তখনো ওরা জানে না যে এরপরে যে এলাকাগুলোতে যাবে, তার প্রতিটিতেই দেখবে স্বতস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধের দৃশ্যপ্রতিটি এলাকার মানুষ পালা করে ১৫-২০ জনের দল নিয়ে রাতে পাহারা দেয়। তাদের সাথে থাকে বাঁশের লাঠি , বল্লম, দা এই জাতীয় অস্ত্র। তারা অনেক সচেতন। তীব্র ঘৃণা নিয়ে অপেক্ষা করে তারা পরের হামলাটির জন্য। পরের বার তারা যুদ্ধ করে মরতে চায়। নিরস্ত্র অবস্থায় মার খেয়ে মরতে চায় না।
বাঁশখালি থেকে ঘুরে আসার ঠিক এক সপ্তাহ পর ‘ম্যাজিক’ নামের টেম্পো জাতীয় একটি গাড়িতে করে প্রতিবাদী গান গাইতে গাইতে সুন্দরগঞ্জের আমাদী গ্রামের দিকে ছুটে চলে সুন্দর চেহারার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, অসম্ভব বুদ্ধিমান ওরা ৬ জন। ফেরার পথে আর গলা দিয়ে গান বেরোয় না কারো। ফিরেই আবার কাজ শুর করতে হবে। রিসার্চ করে বের করতে হবে এরপরে কোথায় যাওয়া যায়।
ওরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু কোন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় ভরে যায় ওদের মন। যখন জাতীয় সঙ্গীত হয়, তখন প্রত্যেকের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় অজানা কারণে। পতাকার দিকে তাকালে নিজের অজান্তেই মুখ স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন অরাজকতা কি হওয়ার কথা ছিল? স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কি এরকম ভয় পেয়ে বেঁচে থাকার কথা? বাংলাদেশ কি আসলেই মুক্ত-স্বাধীন?
সবশেষে ওরা যায় খুলনার কয়রায়। সেখানে গিয়ে তারা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়। ‘না, বাংলাদেশ স্বাধীন না এখনো। শুধু মাত্র ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতাই স্বাধীনতা না। প্রায় ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও কয়রার অবস্থা বাঁশখালী ও সুন্দরগঞ্জের মতোই। ধ্বংসস্তুপ দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই হামলা হয়েছে সেখানে। খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের ধোপাপাড়ার মানুষদের কাছ থেকে ওরা জানতে পারে, জামাত-শিবির ধোপাপাড়ায় হামলা চালিয়ে সব কিছু লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘরজামাত শিবির কর্মীরা ওইদিন পাড়ার হিন্দু নারীদের একা পেয়ে মারধোর করে ঘরে আটকে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাচ্চাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে আগুনের দিকে। চার বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে গেলে ওর মা এসে কেড়ে নেয়তখন শুরু হয় মাকেই বেঁধে পেটানো এরপর বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকেও পেটায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। সেখানেই শেষ না, হামলাকারীরা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘‘পুজা মারাও শুয়োরের বাচ্চারা, পুজা মারাও! পুজা করিয়ে দিচ্ছি তোদের জন্মের মতো'' গানপাউডারে বাড়ি-ঘর যখন পুড়ছে, তখন ত্রাকর্তা হয়ে এগিয়ে আসে এলাকার এক মুসলমান এখানেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যেই বেঁচে যায় ধোপাপাড়ার ৬টি পরিবার। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায়, তাদের মধ্যে সহায়-সম্বলহীন অনেকেই এখন রাত কাটাচ্ছে পোল্ট্রি ঘরে।
১৯৭১ সালে এক বুক আশা আর চোখে সোনালী স্বপ্ন নিয়ে প্রায় খালি হাতেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার অসম সাহসী ছেলে-মেয়েরা। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আসতে আসতে তাদের আশা পরিণত হয়েছে হতাশায়ধূসর হয়ে গেছে তাদের স্বপ্নতারা আর নতুন করে স্বপ্ন দেখে না। তারা যতটুকু দেয়ার তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে দিয়েছে দেশকে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে নতুন প্রজন্মের বিবেকবান এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই আশায় বুক বেঁধেছে। রঙীন স্বপ্ন তাদের চোখে। তারা আর দুর্ণীতি, অবিচার, অনাচার, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা সহ্য করবে না। হয়তো তারাও চল্লিশ বছর পর হতাশ হয়ে যাবে। হয়তো তাদেরও স্বপ্ন ধূসর হয়ে যাবে। কিন্তু ততো দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তৈরি হয়ে যাবে আরো এক ঝাঁক উদ্দাম তরুণ-তরুণী। চাইলেই বাংলাদেশকে একটা খোঁড়া দেশে পরিণত করতে পারবে না মৌলবাদী গোষ্ঠী। বাংলাদেশ এমনই। বাংলাদেশ জন্ম দেয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল মানুষগুলোকে, যাদের বুক ভরা নিরেট ভালবাসা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।