দেড় মাস হল মিলির সাথে ব্রেক-আপ করেছি।
কিছুতেই মানতে চাইছিল না প্রথম প্রথম। কিন্তু এখন মনে হয় মেনেই নিয়েছে। রাত-দুপুরে
আর হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে না। আমিও নির্বিকার থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু
সব সময় পেরে উঠি না। মাঝে মধ্যেই মনে হয় জগৎটা অনেক আনফেয়ার। কখনো কখনো অসহায়
ক্রোধে গ্লাস-প্লেট ছুঁড়ে মারি দেয়ালে। আগে টের পেতাম মা রাতের বেলা নিঃশব্দে এসে
মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর চোখের পানি ফেলছে। এখন আর তাও করে না।
দুই বছর হল আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
লাস্ট স্টেজ। প্রথমে রেডিও থেরাপি চেষ্টা করা হল, তারপর কেমো। জীবনকে নতুন চোখে
দেখা শুরু করলাম আমি। যা ভাল লাগতো, তাই করতাম। কিন্তু নিজের অজান্তেই কাছের
মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় মিলির সাথে ব্রেক-আপ।
এরমধ্যেই একদিন কি যেন মনে হল, রাতারাতি
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি মরণোত্তর দেহ দান করব। যেই ভাবা, সেই কাজ। আইনজীবি খুঁজে
বের করে তার সাথে বসলাম। লিখে দিলাম আমার মৃত্যুর পর মরদেহ কঙ্কাল আকারে ঢাকা
মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য রাখা হবে। বাবা-মা প্রচণ্ড মন খারাপ
করল। গালাগালিও করল। আমার জানাযা হবে না, কবর হবে না। জাহান্নামেও নাকি আমার জায়গা
হবে না।....
না হলে নাই। পরেরটা পরে দেখা যাবে। এখনতো আমি
বেঁচে আছি।
২ মাস আগে ডাক্তার ঘোষণা দিয়ে দিল আমি নাকি
আর বাঁচবো না। এক মাস যদি টিকি সেটাই বেশি। প্ল্যান মাফিক মিলির সাথে ব্রেক আপ
করলাম। কিন্তু কই? আমিতো এখনো বেঁচে আছি।
আর ভাল লাগে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার চেয়ে
ভয়াবহ আর কি হতে পারে!
........
গত সপ্তাহটা খুব কাহিল লাগছিল। পরশুদিন থেকে
হাসপাতালে ভর্তি। সবকিছু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। কারা যেন আসে যায়। কিছু পরিচিত
মুখ, কিছু অপরিচিত। হয়তো জীবনের শেষ কটা দিন কাটাচ্ছি। যাকগে, এত চিন্তা করে কি
হবে? এখনওতো বেঁচে আছি।
........
চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছে। কিন্তু মানুষজনের যা
আক্কেল! আমার মত একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর কানের কাছে বসে কান্নাকাটি জুড়ে
দিয়েছে। বিরক্তির এক শেষ। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে কেঁদেই চলেছে বেআক্কেল
মানুষগুলো।
........
হঠাৎ মনে হল আমার হাতটা ধরেছে মিলি। আপ্রাণ
চেষ্টা করেও চোখটা খুলতে পারলাম না। মা এসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। পাশ ফিরে মায়ের
কোলে মাথা রাখতে গিয়ে বুঝলাম একচুলও নড়তে পারছি না। ধীরে ধীরে মানুষজনের কথা পরিস্কার
হতে শুরু হল। সবাই ভাবছে আমি মরে গেছি। পেট ফেটে হাসি আসছে। কেমন মজাটাই না হচ্ছে।
মরার আগেই বুঝতে পারছি কার কিরকম প্রতিক্রিয়া হবে আমি মরে গেলে। আরো কিছুক্ষণ মজা
দেখি। নিজেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে হচ্ছে। খিক।
........
অনেক অনেক্ষণ পার হয়ে গেছে। মানুষজনের
কান্নার শব্দ কমে এসেছে। কিন্তু এবার মনে
হয় সবাইকে বলে দেয়া উচিত আমি এখনো বেঁচে আছি। হঠাৎ আমাকে ধরে টানা হ্যাঁচড়া শুরু
হল। কিসের ওপর যেন চড়ালো আমাকে। এবারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। দেখি আরো কিছুক্ষণ কি করে
আমাকে নিয়ে। একটু একটু ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। বড় ধাতব কিছু ধরে টানার শব্দ হল।
এক ঝলক হীম শীতল বাতাস এসে লাগল শরীরে। নাহ, এবারে উঠতেই হচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেক
ক্লান্ত লাগছে। আর চোখের ওপর মনে হচ্ছে পাঁচ কেজি ওজনের বাটখারা রেখে দিয়েছে কেউ।
খুলতেই পারছি না।
.......
প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভাংল। হাত পা
জমে যাচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। উঠে
বসতেও পারছি না। ছোট্ট খুপরির মতো কোন ধাতব ঘরে আমাকে রেখেছে। আমি চিৎকার করা শুরু
করলাম।
আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি এখনো বেঁচে
আছিইইইইই...
.....
অনেকদিন পর আমাকে ছোট্ট কুঠুরি থেকে ধরাধরি
করে বের করল। আহ গরম বাতাস। কি যে আরাম লাগছে। কিন্তু এটা কি হচ্ছে? আমাকে মাটির
মধ্যে গর্ত করে শুইয়ে দিল কেন? আমিতো বেঁচে আছি। আর মরে গেলেওতো আমাকে কবর দেয়ার
কথা না। আমিতো মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য আমার দেহ দান করেছি। মাটি চাপা দিয়ে
দিচ্ছে। আমার নাকে-মুখে মাটি ঢুকে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। হাজার হাজার
কেঁচো আমার চারপাশে কিলবিল করছে। বমি আসছে। আমিতো বেঁচে আছিরে বোকা।
.....
যখন মনে হচ্ছিল কবরের নিচে থাকতে থাকতে মরেই
যাব, ঠিক তখন মাটি খুঁড়ে আমাকে কারা যেন বের করল। কোনটাই পরিচিত মুখ না। কেমন যেন
ডাকাত ডাকাত চেহারা এদের। শিষ দিচ্ছে, গান গাইছে আর নিজেদের মধ্যে মস্করা করছে।
ওদের কথা থেকে বুঝলাম ওরা ডোম। আবারও টেনে হিঁচড়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।
আরে বাবা আস্তে ধর না। আমার হাত-পা ছিলে যাচ্ছেতো।
.....
কোথায় নিয়ে এসেছে আমাকে বুঝতে পারছি না।
অ্যাসিড আর ক্ষারের তীব্র ঝাঁঝাঁলো গন্ধে নাক জ্বলছে। আমাকে ধরে চুবিয়ে দিতে
যাচ্ছে ওই অ্যাসিডের মধ্যে। না। এবার আমার সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম। “না। আমি
মরে যাইনি। আমি এখনো বেঁচে আছি”। আমার সারা শরীর ঝলসে যাচ্ছে। মাংস খুলে খুলে
আসছে। আমার শরীর থেকে মাংস খসিয়ে ধীরে ধীরে কঙ্কালে পরিণত করা হচ্ছে আমাকে।
......
আমি এখনো বেঁচে আছি। আর কষ্ট দিও না প্লিজ।
খুব ভাল লাগলো অনি আপু, আমি একটা কল্প তে ঢুকে গেছিলাম। অবাক লেখা, ...~*
ReplyDeletehmm
ReplyDeleteBah chomotkar. Ak taan e pore gelam :)
ReplyDeleteমৃত্যু মানুষ জীবনে সবচেয়ে অদ্ভুত সত্য। লেখা সহজ নয়। কল্পনায় ঢুকতে হয় ভয়ের, অজানার সেই অনিশ্চয়তায়। সাহস লাগে, শক্তিও।
ReplyDeleteভালো লেগেছে।
মৃত্যু মানুষ জীবনে সবচেয়ে অদ্ভুত সত্য। লেখা সহজ নয়। কল্পনায় ঢুকতে হয় ভয়ের, অজানার সেই অনিশ্চয়তায়। সাহস লাগে, শক্তিও।
ReplyDeleteভালো লেগেছে।