কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কি একেই বলে? যে দিকেই তাকাই শুধু
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর, মানুষের কান্না আর হাহাকার। একটা চুলা ছাড়া কিছুই নেই। ধ্বংসলীলার
হাত থেকে রক্ষা পায়নি গৃহপালিত গরুগুলোও। বেঁচে গেছে একটি মাত্র কুঁড়েঘর। সেই
ছোট্ট কুঁড়েঘরে রাত কাটাচ্ছে জনা ত্রিশেক মানুষ। দিন কাটে
খোলা আকাশের নিচে। ঘন্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামাত শিবির
কর্মীরা। কিন্তু ওই এক ঘন্টাই ছিল শীলপাড়াকে
ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট।
২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামাত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমেছে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য।
এরকম কিছু একটা হতে পারে তা
আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু এর মাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারোই।
সন্ধ্যা হতে না হতেই মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ত্রিশের ওপরে। রাত গড়িয়ে সকাল
হতে হতে সেই সংখ্যা অতিক্রম করলো একশ’। জামাত-শিবিরের ধরিয়ে দেয়া
আগুনে জ্বলতে থাকে বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস-আদালত। কোন কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয়
অত্যাচারের শিকার হয় অমুসলিম জনগোষ্ঠী। ভেঙ্গে ফেলা হয় প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হয় মন্দির। পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো
হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের ওপর। উপড়ে ফেলা হয় রেললাইন, পুড়িয়ে দেয়া হয় বাস-ট্রাক, ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকে যানবাহনের
ওপর। ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। সংঘবদ্ধভাবে
আক্রমণ চালানো হয় থানা-পুলিশের ওপর। পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নির্মম
ভাবে হত্যা করা হয় তাদের।
ঘটনার ভয়াবহতা দেখে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছু করার তাগিদে আমরা ক’জন কিছুদিনের মধ্যেই রওনা হই চট্টগ্রামের বাঁশখালীর দিকে। পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তা ছিল একই সাথে করুণ, হৃদয়বিদারী, হতাশাজনক এবং ভীতিকর।
বাঁশখালীতে আমরা পৌঁছেছি ঘটনা ঘটার ৯ দিন পরে।
কিন্তু তখনো দেখে মনে হচ্ছিল গতকালই হামলা করেছে জামাত-শিবির। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে শিল পাড়ার মানুষগুলো। ঘর-বাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়সহ সব কিছু জামাত-শিবির কর্মীদের ধরিয়ে দেয়া
আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামাত শিবির কর্মীরা। অতর্কিত হামলায়
কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাধারণ মানুষতো
বটেই, এমনকি পুলিশও এগিয়ে আসেনি বাধা দিতে।
বাঁশখালি থেকে ঘুরে আসার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা গিয়েছিলাম গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। সেখানে আমরা দেখেছি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানে ভাংচুর চালিয়ে বাজারগুলোকে
ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে জামাত-শিবির কর্মীরা।
শুধু দোকানে হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়ার কারণে অঙ্গচ্ছেদ করে খুন করেছে পানের
দোকানদার, শরিফুল ইসলামকে। এবং
হামলা চালিয়েছে শরিফুলের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর। উপজেলার কঞ্চিবাড়ি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা খাদেম হোসেন ও তার
ছেলের ঘর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে
দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর
স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে মারধোর
করেছে। দুই মেয়ের মধ্যে একজনের মাত্র তিন মাস
আগে সিজারিয়ান হয়েছিলএবং তার সেলাইয়ের জায়গায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে জামাত-শিবির কর্মীরা। জ্বালিয়ে দিয়েছে
সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার সভাপতি কাকলী বেগমের বাড়ি-ঘর।
এর সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়েছে কুরআন শরীফ, হারমোনিয়াম এবং বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক। জামাত-শিবিরের হামলার হাত থেকে রক্ষা পায়নি ওই এলাকার জেলে
পাড়াও। এলাকাবাসীদের কাছ থেকেই জানতে
পারলাম অনেক হামলাকরীই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আপাত দৃষ্টিতে তারা স্থানীয়
প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুন্দরগঞ্জ থেকে ফেরত আসার ১২ ঘন্টার মধ্যে
জামাত-শিবির আবারো হামলা করে শরিফুলের ভাইয়ের ওপর।
সবশেষে আমরা যাই খুলনার কয়রায়। প্রায় ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেখানকার অবস্থাও
বাঁশখালী ও সুন্দরগঞ্জের মতোই। ধ্বংসস্তুপ দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই হামলা
হয়েছে সেখানে। খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের ধোপাপাড়ার মানুষদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, জামাত-শিবির ধোপাপাড়ায় হামলা চালিয়ে সব কিছু লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর। জামাত
শিবির কর্মীরা ওইদিন পাড়ার হিন্দু নারীদের একা
পেয়ে মারধোর করে ঘরে আটকে বাইরে থেকে আগুন
ধরিয়ে দেয় এবং বাচ্চাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে আগুনের দিকে। চার বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে
গেলে ওর মা এসে কেড়ে নেয়। তখন শুরু হয় মাকেই বেঁধে পেটানো। এরপর বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকেও পেটায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। সেখানেই শেষ না, হামলাকারীরা চিৎকার করে বলতে
থাকে, ‘‘পুজা মারাও শুয়োরের বাচ্চারা, পুজা মারাও! পুজা করিয়ে দিচ্ছি তোদের জন্মের
মতো।'' গানপাউডারে
বাড়ি-ঘর যখন পুড়ছে, তখন ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে আসে এলাকার
এক শ্রমিক। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায়, তাদের মধ্যে সহায়-সম্বলহীন
অনেকেই রাত কাটাচ্ছে গোয়াল/পোল্ট্রি ঘরে।
তখনও জানতাম না এমন ধ্বংসলীলা আবারো দেখতে হবে ঠিক ৯ মাসের মাথায়। ২০১৪’র ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের দশম জাতীয়
সংসদ নির্বাচন। এবং আবারো শুরু হয়ে যায় অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা।
নির্বাচনের আগের দিন
দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামের কিছু এলাকায় এই নির্বাচনে ভোট না দেয়ার জন্য এলাকাবাসী
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হুমকি দেয়া হয়। তারপরও তারা ভোট দিতে গেলে নির্বাচনের দিন রাতে
নিরস্ত্র হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে
মানুষরূপী পশুরা।
দুঃখজনকভাবে সরকার ও প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এই
ভীত-সন্ত্রস্ত ও প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
মানুষগুলোকে দেখে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে মনের ভেতরটা। কিন্তু জানি যেতে হবে আরো
অনেকগুলো জায়গায়, দেখতে হবে আরো অনেক কান্না। ১০ই জানুয়ারি দিনাজপুরের কর্ণাইয়ে
থাকা অবস্থাতেই শুরু হয় আমাদের গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি।
১১তারিখ আমরা পৌছাই সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কূপতলা এলাকা (বেড়াডেঙ্গা বাজার) এবং রামজীবন ইউনিয়নের
'কে কয় কাশদহ' গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে। বেড়াডেঙ্গা বাজার এলাকায়
ভোটকেন্দ্র লাগোয়া বেশ কিছু হিন্দু বাড়িতে জামাত-শিবির হামলা করে। তবে এলাকার
মানুষ হামলার কারণে মানসিকভাবে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত থাকলেও শারীরিক ও আর্থিকভাবে
খুব একটা ক্ষতি'র সম্মুখীন হয়নি। কে
কয় কাশদহ গ্রামে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পরিবারের
সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ জামাত-শিবিরের হামলা চলাকালীন
সময়ে স্বচক্ষে তাদের তান্ডব পর্যবেক্ষণ করেন। তান্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন তাঁর
বাড়িতে আশ্রয় নিলে হামলাকারীরা তাঁর বাড়ির সামনের মন্দিরে আগুন দেয়, দেব-দেবীর
মূর্তি ভাংচুর করে এবং বাড়িতে হামলা করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পিছনের দরজা দিয়ে বের হতে গেলে হুড়াহুড়িতে তিনি মারাত্মকভাবে
আহত হন এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির তৃতীয় দিনের মাথায় মানসিকভাবে
মারাত্মক বিপর্যস্ত সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ মৃত্যমুখে ঢলে পড়েন।মৃত্যুর পর
তাঁর স্ত্রী তাঁদের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী পুত্রসন্তান এবং একটি
অবিবাহিত কন্যাসন্তান নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন। সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণের মৃত্যুর
পর এই পরিবারের শুধুমাত্র ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর
পুত্রের ভবিষ্যৎ এবং কন্যার পড়াশোনা ও বিয়ে নিয়ে চিন্তিত মলিনা রাণী অসহায়ের মতো
দিনযাপন করছেন।
এরপর একে একে আমরা যাই যশোরের অভয়নগর, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের
রাণীশংকৈলে। সবখানেই দেখি সাম্প্রদায়িক হামলার একই চিত্র।
এরও ঠিক এগারো মাস পরে আমাদের আবারো দেখতে হয় অমুসলিম জনগোষ্ঠীর হাহাকার।
কিন্তু এবার হিন্দুদের ওপর জামাত-শিবিরের হামলা না, বৌদ্ধ চাকমাদের ওপর বাঙালিদের
হামলা।
পৌষ মাসের শীতে বাড়িঘর হারিয়ে
খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হয়েছিল তারা। সবচেয়ে দুখঃজনক ব্যাপার হলো, ঘটনাটা ঘটেছিল
মহান বিজয় দিবসে। ৪৩ বছর আগে যেই দিনে নিজেদের একটা ভূখন্ড হানাদারদের কাছ থেকে
ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমরা সম্প্রীতি'র সাথে মিলে মিশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে, ঠিক সেই দিনটিতে আমরাই হামলে পড়লাম নির্ঝঞ্ঝাট চাকমা নৃগোষ্ঠীর ওপর।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে রাঙামাটির নানিয়ারচর
উপজেলায় আনারস বাগান নিয়ে বিরোধে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানে
অগ্নিসংযোগ করে একদল বাঙালি। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপজেলার ৩টি গ্রামের মোট
৬১টি পরিবার।
এতো হামলা, এতো অত্যাচার, এতো হাহাকার দেখার পরেও এটাই এপর্যন্ত আমার জীবনে
দেখা সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা।
রাঙামাটির এই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পুড়িয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর-দোকানপাট, নতুন
তোলা আমন ধান। এমনকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোও (জন্ম সনদ, দলিল-দস্তাবেজ,
টাকা-পয়সা, শীতের জন্য গরম কাপড় ইত্যাদি) সংরক্ষণ করতে পারেনি
অসহায় মানুষগুলো। তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দেয়া এই
মানুষগুলো আমাদেরকে ঠিকই আপন করে নিয়েছিল। শুনিয়েছিল তাদের দুর্দশার কথা।
এক চাকমা মা কোনমতে তার ৬ মাসের বাচ্চাকে একটা পাতলা কম্বলে ঢেকে রেখেছিল।
কিন্তু তাও পাহাড়ী ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে গেছিল বাচ্চাটি। আরেক পোড়া বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম আমার জীবনে
দেখা করুণতম দৃশ্য। ছোট্ট ৩ বছরের ফুটফুটে একটা বাচ্চা পোড়া কাঠের কালিতে মাখামাখি
হয়ে ছাইয়ের ওপর বসে পোড়া কাঠ-কয়লা দিয়েই বানাচ্ছে খেলনার উপকরণ। পাশের গ্রামেই
আবার এক থুড়থুড়ে বৃদ্ধা সম্পূর্ণ ভস্মিভূত বাড়ির সামনে ছাইয়ে বসে নিজের মনেই
হাসছেন।
আমাদের একটা সংগঠন আছে, নাম ‘AMRA- Alliance for Mitigating Racism Altogether’।
যাদের কাজ সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। আমদের তীব্র
বাসনা- এই সংগঠনটা কাজের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাক। বিলুপ্ত হোক বাংলাদেশের
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।