Monday, October 22, 2012

কথা

       লালমাটিয়ায় স্বাদ তেহারী ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ঈষাণ। মনে মনে ভাবছিল, ‘মেয়েটাকে দেখে তো অন্য রকম মনে হয়। কিন্তু এরও দেখি বাকি মেয়েগুলোর মতোই দেরি করা স্বভাব। ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে একটা রিক্সা এসে দাঁড়ালো। রিক্সা থেকে লাফিয়ে নেমে ভাড়া না দিয়েই বিরতিহীন ভাবে সরিবলা শুরু করল ইলানা। ঈষাণ হেসে ফেলে বলল, ‘ আগে ভাড়া দাও, তারপর সরি বোলো। তখন ইলানা বলে, ‘নাহ, আজকে রিক্সা করেই ঘুরবো চলো। ঈষাণ কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল রিক্সায়। মেয়েটার মধ্যে কি যেন আছে। খুব মজা করে কথা বলে। অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিষ নিয়ে কথা বলে। প্রতি মুহুর্তেই অবাক হতে হয়।
রিক্সাওয়ালাকে ঢাকা কলেজের দিকে যেতে বলে ইলানা ফিরল ঈষাণের দিকে।


ইলানা: গত ক্লাসে কি চির বন্ধুপুরোটা শিখিয়ে ফেলেছে?


ঈষাণ: হ্যাঁ। চিন্তা করো না, আগামী ক্লাসে আবারো ওটাই করাবে প্রথমে তারপর ধরবে এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। ক্লাসটা মিস কোরো না। কারণ আগামী সপ্তাহ থেকেই রিহার্সেল শুরু হবে। আর কোরাসে থাকবে এই আকাশে আমার মুক্তি


ইলানা: হুম, এটা একটা সমস্যা। ক্লাসে যেতেই ইচ্ছা করে না। কিন্তু একবার গেলে আর ক্লাস থেকে বেরোতে ইচ্ছা করে না। এই আকাশে আমার মুক্তিগানটা মোটামুটি জানা আছে, ফাইন টিউনিং করলেই হয়ে যাবে।


এখন রিক্সাটা ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে বেঙ্গল গ্যালারির সামনে জ্যামে আটকে আছে।


ইলানা: জানো, একটা সময় প্রত্যেকদিন আসতাম বেঙ্গল গ্যালারিতে। আমার একটা বন্ধু আছে, নাম, তপু। ওর সাথে প্রত্যেকদিন বিকালে বের হয়ে এখানে এসে প্রদর্শনীগুলো দেখতাম আর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্টনিয়ে হাসাহাসি করতাম। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম ঘাড় ধরে বের করে দেয় কিনা। হাস্যকর সব পেইন্টিংকে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্টের লেবেল লাগিয়ে সাজিয়ে রাখতো। আর ছবিগুলোর দামও ছিল সেরকম, সবচেয়ে সস্তাগুলোর দামই ছিল ৩০ হাজার টাকা। এখন যদি তিন বছরের একটা বাচ্চার হাতে তুলি ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে-ও ওই ছবিগুলোর চেয়ে ভাল আঁকতে পারবে। আরো মজা হত যেসব দিন এক্সপেরিমেন্টাল আর্টওয়ার্কেরপ্রদর্শনী থাকত। উদ্ভট সব জিনিষ ক্যানভাসের ছবির ওপর আঠা দিয়ে লাগানো। সূতা, দড়ি থেকে শুরু করে জুতার সোল, কাঁচের টুকরা। কবে যে আন্ডারওয়্যার লাগিয়ে দেবে ক্যানভাসের ওপর এটা ভেবে আমি আর তপু হাসি চেপে রাখতে পারতাম না।    


ঈষাণ: আমিও এক সময় নিয়মিত প্রদর্শনীগুলোতে যেতাম। কিন্তু আমার এলাকা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবির হাট আর চারুকলার গ্যালারিতেই পড়ে থাকতাম। আমি অবশ্য তোমাদের মত এত কৌতুক খুঁজে পেতাম না। আর্ট কলেজের গ্যালারিতে সুন্দর সুন্দর ছবি থাকত সব সময়। যত সুন্দর ছবি, তার চেয়েও সুন্দর ছবির পেছনের ফিলোসফিটা। অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্টগুলোও মোটেই হাস্যকর ছিল না। দেখলেই ছবির গভীরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করতো।


ইলানা: ধুর মিয়া, তোমরা হলে আঁতেল গোষ্ঠীর মানুষ। তোমরা তো পাবলিক টয়লেটের মধ্যেও শিল্প খুঁজে পাবে। 
যাক বাঁচা গেল, জ্যাম ছুটেছে। আরে দেখো দেখো, কোয়েলের ডিম বিক্রি করছে। ছোটবেলায় মা আমাকে কোয়েলের দু'টো ডিম একসাথে পোচ করে খাওয়াতো।

ঈষাণ: জানো, আমি আমার জীবনের প্রথম আয় করেছিলাম ডিম বিক্রি করে। আমার যখন তিন বছর বয়স, তখন টাকা উপার্যন করার দূর্দান্ত এক আইডিয়া আসল মাথায়। বাসায় ফ্রিজে সব সময়েই অনেকগুলো ডিম থাকতো। একদিন ফ্রিজ থেকে দু'টো ডিম চুরি করে নিচে গিয়ে মুদির দোকানদারকে বললাম 'এ্যাই মামা, ডিম কিনবে? তিন টাকা।' দোকানদার হেসে কুটিপাটি হলেও আমার কাছ থেকে ঠিকই ছয় টাকা দিয়ে দু'টো ডিম কিনেছিল। পরেরবার অবশ্য চুরি করতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেছিলাম।
বাহ বেশ তাড়াতাড়িই ৩২ নম্বর ব্রিজ পার হয়ে গেলামতো। আরে আরে মজা দেখ। ওই যে ওই দিকে একটা ছেলে পাগলের মত বই আর কি কি যেন ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে লেকের পানিতে। পেছনেই মেয়েটা বসে বসে দেখছে। কত যে নাটক করতে পারে মানুষ! এসব হাস্যকর ছেলেমানুষীর কোন মানেই হয় না।

ইলানা: খবরদার! একদম ফালতু কথা বলবে না। মোটেই মজার কিছু হচ্ছে না ওখানে। ছেলেটার চেহারা দেখো। বোঝাই যাচ্ছে কি পরিমাণ রাগ আর কষ্ট নিয়ে কাজটা করছে সে। আর মেয়েটা পাথরের মত থমথমে মুখে বসে আছে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ছেলেটা এমন করতে পারে। তুমি ওদের জায়গায় নেই। সুতরাং তুমি জান না কি পরিস্থিতিতে এমন করছে ওরা। খামাখা মানুষের কষ্টের মধ্যে মজা খোঁজার চেষ্টা কোরো না।


ঈষাণ: খুব অবাক করলে তুমি। তোমাকে দেখেতো খুবই প্র্যাক্টিকাল আর কাঠখোট্টা মনে হয়। বোঝাই যায় না এই সব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপারে কিছু যায় আসে তোমার। আমিতো আরো মনে করলাম তুমি মজা পাবে দৃশ্যটা দেখে। এই জন্যই দেখালাম। সরি, বুঝতে পারিনি এতো খেপে যাবে।


ইলানা: এইটা একটা ভুল ধারণা। আমি প্র্যাক্টিকাল হতে পারি, কিন্তু তাই বলে অমানুষ না। আমি খুবই আবেগপ্রবণ। যখন প্রেমে পড়েছিলাম তখন প্রচুর পাগলামি করেছিলাম আমিও। যে কেউ শুনলে হাসবে আমাকে নিয়ে। কিন্তু এখনো আমি যখন ভাবি ওই সময়টার কথা; মনে হয়, যা করেছিলাম ঠিকই করেছিলাম। আর আমি মোটেও লজ্জিত না আমার কাজগুলোর জন্য।

ঈষাণ: কি?! তুমি?! তুমি পড়েছিলে প্রেমে?! এটাও সম্ভব? নাহ, আসলেই খুব অবাক হচ্ছি আমি। তুমি কারো প্রেমে পড়তে পারো সেটা বিশ্বাসই হয় না।

ইলানা: হ্যাঁ ভাই, আমিও প্রেমে পড়তে পারি। যদি কথা দাও পরে হাসাহাসি করবে না এটা নিয়ে, তাহলে কার প্রেমে পড়েছিলাম সেটা বলবো।


ঈষাণ: পাগল নাকি!! হাসাহাসি করবো কেন? কার প্রেমে পড়েছিলে বল।


ইলানা: ইউনিভার্সিটি থার্ড ইয়ারে যখন পড়ি, তখন আরিয়ান নামে একটা ছেলের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়। ও দেখতে যেমন সুন্দর, ব্যাবহারটাও তেমনি মিষ্টি। আর কতো কিছু যে জানতো ছেলেটা! এত সুন্দর করে কথা বলতো! ওর সাথে থাকলে কখনোই ক্লান্ত হতাম না। মনে হতো, ওর কথা শুনেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। 

আরিয়ান পড়তো সাইকোলজিতে। ওর সাথে থেকে থেকেই সাইকোলজির প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ জন্মালো আমারসাইকোলজির অনেক বই পড়ে ফেললাম নিজে নিজেই। আমার আগ্রহ দেখে আরিয়ান খুশিতে বাকবাকুম। অনেক দিন ধরেই ও চাচ্ছিল মনোস্তত্ত্ব বিষয়ে একটা মাসিক পত্রিকা বের করতে। আমাকে পেয়ে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। আর আমি ততো দিনে পড়ে গেছি গভীর প্রেমে। পত্রিকা বের করার কাজটা করলে ওর সাথে আরো অনেক সময় কাটাতে পারব আর এই ফাঁকে ওকে আমার মনের কথা বলার সুযোগও তৈরি হয়ে যাবে। এই ভেবে মহা উৎসাহে কোমর বেঁধে ওর সাথে কাজে লাগলাম আমি। অনেক খেটে ৪ পৃষ্ঠার একটা পত্রিকা বেরও করে ফেললাম আমরা। ইউনিভার্সিটিতে ব্যপক আলোড়ন তুললো সেই পত্রিকা। আর এই এক মাসে আমরা আরো অনেক কাছাকাছি চলে এলাম একজন আরেক জনের। 
পত্রিকার নাম 'নাইনথ ওয়েইভ' রেখেছিল আরিয়ান। আমরা সব সময় একটা রেস্টুরেন্টের নয় নম্বর টেবিলে বসে পত্রিকার কাজ করতাম। ওই নয় নম্বর টেবিলে বসেই আমাদের মস্তিষ্কে আইডিয়ার ঢেউ উঠতো বলে 'নাইনথ ওয়েইভ' নাম রাখা হয়। তার আচার আচরণ, কথা-বার্তা শুনে আমার মনে হতে লাগলো সে-ও আমাকে অন্য রকম ভাবে পছন্দ করতে শুরু করেছে। মাঝে মধ্যে কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেলে আমাকে জোর করে রাতের খাবার খাইয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতো। রিক্সা করে ফেরার সময় বলতো, 'প্লিজ আমার হাত ধরে রাখো, আমার ভয় করে, যদি রিক্সা থেকে পড়ে যাই।?' আমিও মনের সুখে আরিয়ানের হাত ধরে রাখতাম পুরো রাস্তা।
মাঝে একবার জ্বর হয়েছিল বলে কাজ করতে পারিনি বেশ কিছুদিন। আরিয়ান তখন প্রত্যেকদিন ক্লাস শেষ করে, পত্রিকার কাজ শেষ করে, আসত আমার বাসায়। প্রতিবারই ফল-মূল, চকোলেট বা কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। সেই সময় আমার ভালবাসা তুঙ্গে পৌঁছালো। জ্বর যখন প্রায় সেরে এসেছে, তখন একদিন আরিয়ানকে সাহস করে বলেই ফেললাম আমার মনের কথাটা। শুনে আরিয়ান এতোই অবাক হলো যে ওর হাত থেকে চায়ের কাপ-টা পড়ে ভেঙ্গে গেলো।
শুকনো ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে খেতে আরিয়ান বললো, 'ইলানা, আমিতো সমকামী। তুমি জানতে না? কখনো বোঝোনি? আসলে আমারই ভুল। তুমি আমার এতো ভাল বন্ধু, তোমাকে বললেই পারতাম খোলাখুলি। আসলে আমাদের দেশে এখনো এই ব্যপারটাকে এতো ছোট চোখে দেখে যে আমি সাহসই পাই না কাউকে বলার' 
আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে ভাঙ্গেনি। কিন্তু আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেছিল ওই দিন। এতো অসহায় কখনো লাগেনি নিজেকে। আরিয়ানের অদ্ভুত মিষ্টি কিন্তু মেয়েলি স্বভাবের কারণটা বুঝতে পারলাম এতো দিনে। রিক্সায় উঠলে আসলেই ভয় পেতো বলে আমার হাত ধরে রাখতো সে। হাত ধরার পেছনে লুকানো কোন ভালবাসা ছিল না। 
প্লিজ ঈষাণ, হেসো না। ধুর, এই জন্যেই বলতে ইচ্ছা করে না কাউকে 

ঈষাণ: সরি সরি। এটা মোটেই হাসির কোন গল্প না কিন্তু কেন জানি হাসি থামাতে পারছি না। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।


ইলানা: না, আসলেই হাসির কোন গল্প না এটা। আমি চোখে অন্ধকার দেখছিলাম তখন। মনে করেছিলাম আমার ভালবাসার তীব্রতা দিয়ে আরিয়ানকে বাধ্য করতে পারব আমাকে ভালবাসতে। চূড়ান্ত পাগলামী করেছিলাম টানা ছয় মাস। এর মধ্যে দুইবার আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয়নি। ও কখনোই আমাকে ভাল বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু মনে করেনি, করা সম্ভবও ছিল না ওর পক্ষে। কাজের কাজ যেটা হল, আমি খুব ভাল একটা বন্ধু হারালাম। শেষ দিকে আরিয়ান এতোই বিরক্ত হয়ে উঠেছিল যে আমার সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। 


       রিক্সা এখন সিটি কলেজের সামনে। হঠাৎই ইলানা রিক্সাটাকে দাঁড়াতে বলে।

আচ্ছা, আজকে সোমবার না? আলিয়াঁস ফ্রাসেসে নাচের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা আজকে থেকেই। ইশ মনেই ছিল না। ঈষাণ, আমি খুবই সরি; কি কি কাজ আছে খেয়াল না করেই বের হয়ে পড়লাম তোমার সাথে। প্রথম ক্লাসটা মিস করতে চাই না। এখন আমি যাই? কালকে তোমার সাথে দেখা করি? তুমি ফ্রি থাকবে?

ঈষাণ: অবশ্যই ফ্রি থাকবো। যেতে যখন হবেই, যাও। কাল পর্যন্ত ভাল থেকো....

       ঈষাণকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আলিয়াঁস ফ্রাসেসের দিকে দৌড়াতে শুরু করে ইলানা। যতোক্ষণ ইলানাকে দেখা যায় ততোক্ষণ তাকিয়ে থাকে ঈষাণ। তারপর রিক্সা ঘুরাতে বলে।
ইলানার সাথে গল্প করতে খুব ভাল লাগে। মন ভাল হয়ে যায় সব সময়। কিন্তু আজকে কেমন যেন একটা অতৃপ্তি রয়ে গেল। আরো অনেক্ষণ ইলানার সাথে থাকতে পারলে ভাল হতো। ইলানা যেমন আরিয়ানের কথা শুনে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, ঈষাণেরও মনে হচ্ছে ইলানার কথা শুনে সে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।    




Sunday, October 7, 2012

পর্দার আড়ালে : ডিজনির প্রথম অ্যানিমেশন

১৯৩৭ সালে মুক্তি পাওয়া ডিজনির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশনটি ছিল 'স্নো ওয়াইট এন্ড দ্য সেভেন ডুওয়ার্ফস। পঁচাত্তর বছর আগে অ্যানিমেশন ফিল্ম বানানোটা এত সহজ ছিল না। তখন ছিল না কোন কম্পিউটার, কোন প্রযুক্তি। ঠিক কিভাবে ঐ সময় এমন একটি ফিল্ম বানানো হয়েছিল, সেটা বোঝার জন্য যেতে হবে সে সময়ের ডিজনি স্টুডিওর ভেতরে।

সাতশ'রও বেশি সৃজনশীল কর্মী তখন দিন-রাত খেটে কাজ করেছেন এই পরীক্ষামূলক অ্যানিমেশনটির জন্য। প্রথম কাজ ছিল একটা চমৎকার গল্প খুঁজে বের করা। তার পর শুরু হয় আসল কঠিন কাজ।

প্রতিটা ফ্রেমের প্রতিটা ছবি আঁকতে হয়েছে তাঁদের নিজ হাতে। অনেক আঁকি-বুঁকির পর তাঁরা শেষ পর্যন্ত কয়েকশ' খসড়া ছবি দাঁড় করায়। ওদিকে স্ক্রিপ্ট আর ডায়ালগ তৈরি করে ফেলেন পরিচালক। এরপর সঙ্গীত পরিচালকদের সাহায্যে তৈরি করেন প্রতিটি দৃশ্যের জন্য মিউজিক।

টেস্ট ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টে অ্যানিমেটরদের খসড়া ড্রইংগুলোর ছবি তুলে ফেলা হয় সিকুয়েন্স অনুযায়ী। অ্যানিমেটর প্রজেক্টরের সাহায্যে দেখে নেন ছবিগুলো কতোটা ভাল হয়েছে।

যথেষ্ট ভাল হলে, হাজার হাজার পেন্সিলে আঁকা ছবি চালান করে দেয়া হয় ইংকিং ডিপার্টমেন্টে। এখানে শত-শত মেয়ে ড্রইংগুলোকে স্বচ্ছ সেলুলয়েড দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর তাঁরা প্রত্যেকটি লাইন কালি দিয়ে ট্রেইস করেন। এবার ছবিগুলো তৈরি হয়ে যায় শেষ প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য। সেটি হল, ছবিগুলোকে রং করা। ল্যবরেটরিতে অভিজ্ঞ রসায়নবিদরা এই অ্যানিমেশনের জন্য তৈরি করেছিলেন ১৫ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন শেডের রং। সেই রং দিয়ে ছবিগুলোতে প্রাণ দেওয়া হয়। অন্য দিকে একই সাথে আঁকা হতে থাকে ব্যাকগ্রাউন্ডের স্টেজ সেটিং এর ছবি। ছবিগুলো আঁকা হয় জল রঙে।

কিন্তু আসল কাজ এখনো বাকি। সেলুলয়েড আর ব্যাকগ্রাউন্ডকে একসাথে করে মাস্টার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হয়। এর পর ফিল্ম চলে যায় টেকনিশিয়ানদের হাতে। আর রেকর্ড হতে থাকে সাউন্ড এফেক্ট। সব শেষে ফিল্মটির জন্য রেকর্ড করা হয় অর্কেস্ট্রার মিউজিক।

আর এর সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে অ্যানিমেশনের ইন্দ্রজাল।

Saturday, October 6, 2012

ইউ-টু


আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশের চেয়ে খুব বেশি উন্নত ছিল না কিছু দিন আগেও। ৭০-এর দশকে হঠাৎ করেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে আইরিশ সংস্কৃতিতে। সে সময়কার যুব সমাজের মধ্যে থেকে যে ক’টা চেহারা পুরো পৃথিবীতে পরিচিত হয়ে যায়, তাদের মধ্যে চার জন হল, পল ডেভিড হিউসন ওরফে বনো, ডেভিড হাউয়েল ইভ্যানস ওরফে দ্য এজ ( the edge), অ্যাডাম ক্লেটন আর ল্যারি মিউয়েল জুনিয়র।
এই চারজন মিলে ১৯৭৬ সালে গড়ে তোলে ইউ-টু ব্যান্ডটি। পাঙ্ক থেকে শুরু করে রক পর্যন্ত সব ধরণের মিউজিকই কম্পোজ করেছে ব্যান্ডটি। যখন তৈরি হল এই ব্যান্ড, তখন এর সদস্যরা মাত্র টিনেজার। কিন্তু দশক ঘুরতে না ঘুরতেই তারা প্রথম সারির আন্তর্জাতিক পারফর্মার হয়ে দাঁড়ালো। ১৯৮৭ সালে বের হল তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অ্যালবাম, দ্য জশুয়া ট্রি’। রোলিং স্টোনস ম্যাগাজিন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে লিখেছিল, ‘বীর বিপ্লবী থেকে মহাতারকায় পরিণত হয়েছে ইউ-টুর সদস্যরা’।

এ পর্যন্ত তারা ১২টি অ্যালবাম মুক্তি দিয়েছে, যার ১৫০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। আর অসাধারণ সব গান গেয়ে ঝুলিতে ভরেছে ২২টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড,  যা পৃথিবীর অন্য যে কোন ব্যান্ডের চেয়ে বেশি। সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ শিল্পীর তালিকায় যে তাদের নাম থাকবে তা তো খুবই স্বাভাবিক। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই তারা যুদ্ধ করে গেছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য। প্রায় চার দশক ধরে একই রকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখে এখনো দর্শক মাতিয়ে চলেছে ইউটু।