কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কি একেই বলে? যে দিকেই তাকাই শুধু পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর, মানুষের কান্না আর হাহাকার। একটা চুলা ছাড়া কিছুই নেই। ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পায় নি গৃহপালিত গরুগুলোও। বেঁচে গেছে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। সেই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে রাত কাটাচ্ছে জনা ত্রিশেক মানুষ। দিন কাটে খোলা আকাশের নিচে। ঘন্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামাত শিবির কর্মীরা। কিন্তু ওই এক ঘন্টাই যথেষ্ট ছিল শীলপাড়াকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার জন্য।
২৮শে ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন
সাঈদীর ফাঁসির রায়টি ছিল শাহবাগে ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থান নেওয়া অসংখ্য তরুণ-তরুণীর
অন্যতম বিজয়। রায়টি হওয়ার সাথে সাথে শাহবাগ থেকে বের হয় বিজয় মিছিল। আনন্দে
আত্মহারা হয়ে একে অপরের সাথে করমর্দন এবং কোলাকুলি করে সেখানে অবস্থানরত জনতা।
তারা তখনো জানত না আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ পরিণত হবে এক রণক্ষেত্রে।
পুড়িয়ে দেওয়া হবে বাড়িঘর-দোকানপাট, খুন করা হবে
মানুষ, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে গ্রামের পর গ্রাম।
২৮শে ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে
আমির দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের
বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে জামাত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমেছে
ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য। এরকম কিছু একটা হতে পারে তা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল।
কিন্তু এর মাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারোই। সন্ধ্যা হতে না হতেই
মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ত্রিশের ওপরে। রাত গড়িয়ে সকাল হতে হতে সেই সংখ্যা
অতিক্রম করলো একশ’। জামাত-শিবিরের ধরিয়ে দেয়া আগুনে
জ্বলতে থাকে বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস-আদালত। কোন কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয়
অত্যাচারের শিকার হয় অমুসলিম জনগোষ্ঠী। ভেঙ্গে ফেলা হয় প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হয় মন্দির। পরিকল্পিতভাবে হামলা
চালানো হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের ওপর। উপড়ে ফেলা হয় রেললাইন, পুড়িয়ে দেয়া হয়
বাস-ট্রাক, ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকে যানবাহনের ওপর।
ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ
চালানো হয় থানা-পুলিশের ওপর। পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নির্মম ভাবে
হত্যা করা হয় তাদেরকে।
পহেলা মার্চ থেকে শুরু হয় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর লম্ফ-ঝম্প। এবং
৫ই মার্চ মুখ খোলেন বেগম জিয়া। সেই মুখ থেকে বের হয়ে আসা একটি শব্দে স্তম্ভিত
হয়ে যায় প্রগতিশীল তরুণ সমাজ। শব্দটি ছিল ‘গণহত্যা’। মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও বক্তব্য মোটা দাগে একই- ‘গণহত্যা চলছে বাংলাদেশে’। ২৮শে
ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই তাণ্ডবের বর্ণনা ঢালাওভাবে
গণমাধ্যমগুলোতে
প্রচারিত
হতে থাকে। প্রশাসন, আইনশৃংখলা বাহিনীর
নিষ্ক্রিয়তা-অসহায়ত্ব, ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা এবং নিরীহ মানুষের হাহাকার দেখে পুরো জাতি এক অসহায় আক্রোশে কাঁপতে থাকে।
অবস্থার উন্নতির কোন আলামত যখন দেখা গেলো না, তখন ক্রমশ নিকষ কালো অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হতে থাকে আমার। আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় যেই মুহুর্তে আমাকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গ্রাস করছে, ঠিক সেই মুহুর্তে মিরপুরের এক ডর্মিটরিতে বসে এক তরুণী তার বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুন ছাই দিয়ে চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। অনলাইন ঘেঁটে দেখছে কোথাও এক চিলতে আশার আলো দেখা যায় কিনা। একই সময় শেওড়াপাড়ায় এক তরুণ গালি দিয়ে জামাত-শিবিরের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে। কিন্তু তাও শান্ত হচ্ছে না তার মন। নিকেতনে এক তরুণী তার প্রবাসী বন্ধুর কাছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করতে করতে কেঁদে ফেলেছে। ওরা সবাই আমার মতোই কিছু একটা করতে চায় এই নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্য। কিন্তু কিভাবে কি করবে কিছু বুঝে পাচ্ছে না। জামাত-শিবিরের সহিংসতা ভাবিয়ে তুলছে ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে থাকা শত শত তরুণ-তরুণীকে। আমরা কেউই তখনো জানতাম না এর ঠিক এক ঘন্টা আগে মোহাম্মদপুরের এক তরুণ ফেইসবুকে একটি ইভেন্ট খুলেছে। ইভেন্টটির নাম: ‘সাপোর্টিং দ্য ভিক্টিমস অফ জামাত- শিবির অ্যাটাকস’।
এরপরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে খুব দ্রুত। ফেইসবুকের ওই ইভেন্টে যোগ দেই আমরা অনেকেই। কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই হাতেগুনে ৫ জন। শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহল থেকে অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহের কাজ। গঠিত হয় একটি ছোট্ট রিসার্চ টিম। যারা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে এবং স্থানীয় লোকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একেকটি এলাকার ক্ষতির পরিমাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু তখনো আক্রান্ত এলাকাগুলো দুর্ভেদ্য। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে ওই এলাকাগুলোতে যাব। ভাবছিলাম কিভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। আমরা সাহায্য দিয়ে আসার পর পরই যে আবারো ক্ষতিগ্রস্তদের ওপর হামলা চালাবে না জামাত-শিবির সেই নিশ্চয়তা দেয়ার মতো কাউকে খুঁজছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না।
তখন আমাদের রিসার্চের আলোকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখলাম আক্রান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে নোয়াখালির বেগমগঞ্জে যাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু একই কারণে সেখানে ইতিমধ্যে অনেক সংগঠন থেকে সাহায্য করার জন্য মানুষ গেছে। ঠিক তখন আমাদের কাছে খবর এলো মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের বাঁশখালী পরিদর্শনে যাবেন পরের দিনই। শোনা মাত্রই আমরা লাফ দিয়ে উঠলাম। এই তো সুযোগ! এই সুযোগকে কাজে লাগাতেই হবে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের জন্য ওই এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। সুতরাং আমাদের মিশে যেতে হবে ওই দলের সাথে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ! পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ৪ জন রওনা দিলাম বাস ধরার উদ্দেশ্যে।
চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানোর পর হঠাৎই খেয়াল হল, আমাদের এই ছোট্ট দলটার কোন পরিচয় নেই। আমরা নিজেদের জন্য কোন নাম ঠিক করিনি। শহর থেকে বাঁশখালী যাওয়ার পথে নিজেদের মধ্যে ছোট খাট তর্কও হয়ে যায় নাম নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমাদের নাম হবে ‘আমরা’। কারণ, ‘আমরা’ শব্দটি অনেক আপন। আমরা ‘ওরা’ নই যারা নৈরাজ্য চালাচ্ছে পুরো দেশে। আমরা শব্দটি বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। এবং একের অধিক মানুষ যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়, তখনই সেটা ‘আমরা’ হয়ে যায়। একতার ন্যূনতম একক ‘আমরা’। শুরুটা এভাবেই। ৩রা মার্চ জন্ম নেয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'আমরা'।
বাঁশখালী পৌঁছে যেই দৃশ্য দেখলাম তা ছিল একই সাথে করুণ, হৃদয়বিদারী, হতাশাজনক এবং ভীতিকর। কিন্তু এতে আমাদের চোখে জল এলো না। বরং রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় শক্ত হয়ে উঠলো আমাদের চোয়াল। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ভেঙ্গে পড়ার বদলে আমরা সবাই আরো শক্ত আরো উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠেছি। আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিলাম। আমি নিজের কাছে ২টা প্রতিজ্ঞা করলাম ‘প্রতিরোধ করতে না পারি, প্রতিশোধ নেবই’ এবং ‘মার খেয়ে মরবো না, মেরে মরবো’। অসহায় নিরিহ মানুষগুলোর পাশে শুধু মাত্র অর্থ সাহায্য নিয়ে দাঁড়ালেই হবে না। তাদেরকে নৈতিক সমর্থনও দিতে হবে। ওদের জানতে হবে ওরা একা না, এই যুদ্ধে আমরাও তাদের পাশে আছি। ওদের বুঝতে হবে ওদের দুঃসময়ে, ওদের প্রয়োজনে আমরা বারবার ছুটে আসব বাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত থেকে।
বাঁশখালীতে আমরা পৌঁছেছি ঘটনা ঘটার ৯ দিন পরে। কিন্তু তখনো দেখে মনে হচ্ছিল গতকালই হামলা করেছে জামাত-শিবির। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে শিল পাড়ার মানুষগুলো। ঘর-বাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়সহ সব কিছু জামাত-শিবির কর্মীদের ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামাত শিবির কর্মীরা। অতর্কিত হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাধারণ মানুষতো বটেই, এমনকি পুলিশও এগিয়ে আসেনি বাধা দিতে। কিন্তু একটা সময় হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়েই রুখে দাঁড়ায় স্থানীয়রা। তাদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে বাধ্য হয় জামায়াত-শিবিরের উন্মত্ত কর্মী-সমর্থকরা। স্থানীয়দের কাছ থেকে এই বর্ণনা শুনে এক চিলতে আলোর উজ্জ্বলতা দেখতে পেলাম আমরা। সাম্প্রদায়িক বর্বরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সম্প্রীতির শক্তিটাও দেখলাম। কিছুটা আশান্বিত হলাম। কিন্তু তখনো বুঝিনি এরপরে যে এলাকাগুলোতে যাব, তার প্রতিটিতেই আমরা দেখব স্বতস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধের দৃশ্য। প্রতিটি এলাকার মানুষ পালা করে ১৫-২০ জনের দল নিয়ে রাতে পাহারা দেয়। তাদের সাথে থাকে বাঁশের লাঠি , বল্লম, দা এই জাতীয় অস্ত্র। তারা অনেক সচেতন। তীব্র ঘৃণা নিয়ে অপেক্ষা করে তারা পরের হামলাটির জন্য। পরের বার তারা যুদ্ধ করে মরতে চায়। নিরস্ত্র অবস্থায় মার খেয়ে মরতে চায় না।
বাঁশখালি থেকে ঘুরে আসার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা গিয়েছিলাম গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। সেখানে আমরা দেখেছি গ্রামের পর গ্রামে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানে ভাংচুর চালিয়ে বাজারগুলোকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে জামাত-শিবির কর্মীরা। শুধু দোকানে হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়ার কারণে অঙ্গচ্ছেদ করে খুন করেছে এক পানের দোকানদার, শরিফুল ইসলামকে। এবং হামলা চালিয়েছে শরিফুলের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর। উপজেলার কঞ্চিবাড়ি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা খাদেম হোসেন ও তার ছেলের ঘর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে মারধোর করেছে। দুই মেয়ের মধ্যে একজনের মাত্র তিন মাস আগে সিজারিয়ান হয়েছিলএবং তার সেলাইয়ের জায়গায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে জামাত-শিবির কর্মীরা। জ্বালিয়ে দিয়েছে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার সভাপতি কাকলী বেগমের বাড়ি-ঘর। এর সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়েছে কুরআন শরীফ, হারমোনিয়াম এবং বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক। জামাত-শিবিরের হামলার হাত থেকে রক্ষা পায়নি ওই এলাকার জেলে পাড়াও। জেলে পাড়া পেরোলে চর এলাকার দেখা মেলে, যেখানে জমি চাষ করে ফসল ফলানো হয়। শ্যামল বরণ বাংলা মায়ের অপরূপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এলো। অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য। বাংলাদেশ এতো সুন্দর কেন? আর এই অপরূপ বাংলাদেশকে আমরা কি করে নিজ হাতে নিঃশেষ করে ফেলছি? এর কয়েক কিলোমিটার পেছনেই কিভাবে নৃশংস ভাবে মানুষ খুন করা হচ্ছে? কিভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শান্তিপ্রিয় মাটির মানুষগুলোর ঘরবাড়ি? এলাকাবাসীদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম অনেক হামলাকরীই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আপাত দৃষ্টিতে তারা স্থানীয় প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুন্দরগঞ্জ থেকে ফেরত আসার ১২ ঘন্টার মধ্যে জামাত-শিবির আবারো হামলা করে শরিফুলের ভাইয়ের ওপর।
সবশেষে আমরা যাই খুলনার কয়রায়। প্রায় ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেখানকার অবস্থাও বাঁশখালী ও সুন্দরগঞ্জের মতোই। ধ্বংসস্তুপ দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই হামলা হয়েছে সেখানে। খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের ধোপাপাড়ার মানুষদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, জামাত-শিবির ধোপাপাড়ায় হামলা চালিয়ে সব কিছু লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর। জামাত শিবির কর্মীরা ওইদিন পাড়ার হিন্দু নারীদের একা পেয়ে মারধোর করে ঘরে আটকে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাচ্চাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে আগুনের দিকে। চার বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে গেলে ওর মা এসে কেড়ে নেয়। তখন শুরু হয় মাকেই বেঁধে পেটানো। এরপর বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকেও পেটায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। সেখানেই শেষ না, হামলাকারীরা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘‘পুজা মারাও শুয়োরের বাচ্চারা, পুজা মারাও! পুজা করিয়ে দিচ্ছি তোদের জন্মের মতো।'' গানপাউডারে বাড়ি-ঘর যখন পুড়ছে, তখন ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে আসে এলাকার এক মুসলমান। এখানেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যেই বেঁচে যায় ধোপাপাড়ার ৬টি পরিবার। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায়, তাদের মধ্যে সহায়-সম্বলহীন অনেকেই এখন রাত কাটায় গোয়াল/পোল্ট্রি ঘরে। ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম মাথার মধ্যে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, 'মুক্তিযুদ্ধ কেমন ছিল'?
আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। ছোটবেলায় যখন বাবা-মার কাছে রাজাকারদের গল্প শুনতাম তখন ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত। রাতের পর রাত দুঃস্বপ্ন দেখতাম। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প শুনতাম, তখন মনে হতো, ‘ইশ, আমার কেন মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম হলো না’! আমার আজীবন আক্ষেপ আমি ‘১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১’ দেখতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হয় ভালই হয়েছে আমি অনেক পরে জন্মেছি। কোটি কোটি মানুষের স্বজন হারানোর দুঃখ নিজের চোখে দেখতে হয়নি। এখন যেই নৃশংসতা দেখছি, সেটা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহতার মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু এখনই মনে হচ্ছে ‘আর দেখতে চাই না। আর কখনো এই ভাবে নিরীহ মানুষের কষ্টগুলো দেখতে চাই না’। কিন্তু আমি জানি আমাদের আরো দেখতে হবে। এ-তো মাত্র শুরু। হয়তো সারা জীবনই আমাদেরকে যুদ্ধ করে যেতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে, এটা তাদের যুদ্ধ না। তারা ক্লান্ত। এই যুদ্ধটা আমাদের। বুকে হাত রেখে একটা কথাই বলতে পারি, যতক্ষণ বেঁচে থাকব, ততক্ষণ আমরা সেই অসহায় নিরীহ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে যাব।
Sahoshi deshPremik n Progotoshil nari,apnader motoy meye aii deshe khub besi dorkar,Valo step niyesen,amrao apnader sathe asi...
ReplyDelete'আমরা' এভাবেই এগিয়ে যাব। খুব খুব আশা করি জয়টা আমাদেরই হবে, ওদের নয়।
ReplyDeleteশুভকামনা। :)
লেখা ভালো হয়েছে।
ReplyDeleteThis comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDelete'Amra'r jonno onek shuvokamona thaklo!
ReplyDelete